সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার আদর্শ এবং গুরুত্ব

- আপডেটের সময় : ০২:৪৬:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ জুলাই ২০২১
- / ২৩৭৭
মোহাম্মদ আলমগীর (জুয়েল) : প্রিয় পাঠক, আমি আজ লেখা সূচনা করেছি এক মহান পেশা সাংবাদিকতা নিয়ে। যেটা আমাদের সমাজে অনেক চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। সেই চ্যালেঞ্জকে সাহসিকতার সহিত কিছু তরুণ ও তরুণী সদা হাসি মুখে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে উদ্যম ভয়-ডরহীন কাজে যোগ দেয়। যা একসময় কল্পনাও করা যেতনা। কেননা সমাজ বাস্তবতায় সন্তানদের বাবা ও মায়েরা ধারণা পোষণ করতো এটা আবার কোনো চাকরি হয় নাকি? বাংলাদেশের বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান প্রবীণ সাংবাদিক জনাব মোঃ মুসা এই প্রসঙ্গে এক সেমিনারে বলেন, আমাদের সময় কন্যার বাবা-মায়েরা বিয়ের জন্য পাত্র চাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ছোট করে লিখে দিতো, কোনো সাংবাদিকের আবেদন গ্রহণযোগ্য হবেনা। তাছাড়া সাংবাদিকতায় যে পড়ালেখার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ আছে তখন অনেক বাবা-মা সেটাও জানতেন না। যদিও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বিভাগ হিসাবে চালু হয়। ২০১২ সালে এর ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করা হয়। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
প্রসঙ্গক্রমে, আজকের আলোচনায় সাংবাদিকতা কি এবং কেন এর চাহিদা এবং বৈশিষ্ট্য নিম্নরুপ– ইংরেজিতে ‘জার্নাল ও ইজম’ এই দুই শব্দের মিলনে জার্নালিজম। জার্নাল শব্দের অর্থ হচ্ছে কোনো কিছু প্রকাশ করা। ইজম শব্দের মানে হচ্ছে কোনো কিছু অনুশীলন বা চর্চা করা।
প্রশ্ন করা যেতে পারে সাংবাদিকতা কি? সাংবাদিকতা হল বিভিন্ন ঘটনাবলী, বিষয়, ধারণা ও মানুষ সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরী ও পরিবেশনা। যা উক্ত দিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
এই পেশা তথ্য সংগ্রহের কৌশল ও সাহিত্যিক উপায় অবলম্বনকে মুদ্রিত, টেলিভিশন, বেতার ইন্টারনেট এবং পূর্বে ব্যবহৃত নিউজরিল সংবাদ মাধ্যমের অন্তর্গত। সাংবাদিকতার যথোপযুক্ত নিয়মের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। অফিসে কর্মরত সম্পাদক, উপ সম্পাদকীয়, লেখক, বার্তা সম্পাদক, ফিচার সম্পাদক, প্রতিবেদক, প্রতিনিধি, লিপিবদ্ধকার, আলোকচিত্রী ও প্রুফ রাইডার সকলেই সাংবাদিক।
এরা খবরের সন্ধান করেন, খবরের পেছনে ছোটেন, খবর নির্বাচন করেন। সাংবাদিক যা করেন তা হচ্ছে সাংবাদিকতা। অন্যদিকে সাংবাদিকতা হচ্ছে কাজ। এদের কাজ হচ্ছে তথ্য সংগ্রহ করা, প্রতিবেদন লেখা এবং সম্পাদনা করা।
সংবাদ হলো চলতি ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ। যা পাঠকের আগ্রহ উদ্দীপ্ত করে। এ কথাটাকে একটু কঠিন কিংবা গাণিতিকভাবে বললে এভাবে বলা যায়, সাংবাদিকতা কাকে বলে? অপসাংবাদিকতা কাকে বলে?
অল্প কথায়- 5W, 1H যার পূর্ণরূপ 5W মানে- What (কি?), Where (কোথায়?), Who (কে?), Whom (যাকে/কাকে?), When (কখন?), আর 1H মানে How (কিভাবে?) গাণিতিকভাবে উপরের এই ৬ টি বিষয়কে সামনে রেখে সংবাদ তৈরী করাকে সাংবাদিকতা বলে।
আর এই ৬টি বিষয়ের সাথে আরও ১টি বিষয় যুক্ত করে সংবাদ তৈরী করাকে বলে অপসাংবাদিকতা। সে বিষয়টি গাণিতিকভাবে বললে Y অর্থাৎ Yellow (হলুদ)। আর এই Y শুধু একটি বিষয় না এটি অনেকগুলো বিষয়ের সমষ্টি। যেমন- মিথ্যা, প্রতারণা, শত্রুতা, ভিত্তিহীন ইত্যাদি। ইহা নাগরিক জীবন ও সমাজে অনেক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে থাকে। আমাদের উচিৎ হলুদ সাংবাদিকতা এড়িয়ে চলা এবং সঠিক সংবাদ পরিবেশন করা।
বিভিন্ন ধরনের পাঠকের জন্য সাংবাদিকতার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। একটি একক প্রকাশনায় (যেমন- সংবাদপত্র) বিভিন্ন ধরনের সাংবাদিকতা উপাদান থাকে এবং প্রত্যেক উপাদান বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা ওয়েবসাইটের প্রত্যেকটি বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের জন্য সংবাদ সরবরাহ করে থাকে।
সাংবাদিকতার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধরন নিয়ে এবার সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিন্মে উপস্থাপন করলাম-
ওকালতি সাংবাদিকতাঃ কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা পাঠকের মতামতের উপর সমর্থন করে লেখা হয়।
সম্প্রচার সাংবাদিকতাঃ বেতার বা টেলিভিশনের জন্য লিখিত সাংবাদিকতা।
নাগরিক সাংবাদিকতাঃ নাগরিকদের অংশগ্রহণমূলক সাংবাদিকতা।
উপাত্ত সাংবাদিকতাঃ ঘটনাবলী সংখ্যায় খুঁজে বের করার এবং তা সংখ্যায় বের করার রীতি।
ড্রোন সাংবাদিকতাঃ ড্রোন ব্যবহার করে বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করা।
গঞ্জো সাংবাদিকতাঃ গঞ্জো সাংবাদিকতা হলো প্রতিবেদন প্রণয়নের নিজস্ব উপায়।
পারস্পরিক ক্রিয়াশীল সাংবাদিকতাঃ অনলাইন সংবাদ করার একটি ধরন যা ওয়েবে উপস্থাপন করা হয়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাঃ সামাজিক সমস্যাসমূহ উদঘাটন করে এমন প্রতিবেদন।
আলোকচিত্র সাংবাদিকতাঃ চিত্রের সাহায্যে সত্য ঘটনা সমূহ রীতি।
সেন্সর সাংবাদিকতাঃ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সেন্সর ব্যবহার করা হয়।
টেবলয়েড সাংবাদিকতাঃ বিনোদনমূলক সংবাদ প্রণয়ন যা মূলধারার সাংবাদিকতা থেকে কম বৈধ।
হলুদ সাংবাদিকতাঃ যাহা পূর্বে আলোচনা করছি। এটি গুজব, মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত বিষয়ক প্রতিবেদন।
ক্রীড়া বিষয়ক প্রতিবেদনঃ অপেশাদার এবং পেশাদার ক্রীড়া খবর এবং ঘটনা রিপোর্ট উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে। ক্রীড়া সাংবাদিক সকল প্রিন্ট, টেলিভিশনে সম্প্রচার এবং ইন্টারনেটসহ মিডিয়াতে কাজ করে।
একজন সাংবাদিক সত্যিকার অর্থে তখন সফল হয়, যখন সে সর্বত্র সঠিক সংবাদ পরিবেশন করার লক্ষ্যে তার জ্ঞান, বিদ্যা ও উপস্থিত বুদ্ধির সমন্বয়ে উপস্থাপন ও তথ্য উপাত্ত সঠিক ও নির্ভুলের সাথে সোর্স নির্বাচন ভালো হয়।
যদি কোনো সাংবাদিক বলে, আজ কোনো সংবাদ নেই। তাহলে বুঝতে হবে তার জ্ঞান, উপলব্ধি, চেতনা শক্তি সত্যি হ্রাস পেয়েছে। কেননা, খুন, রাহজানি, ছিনতাই, নারী ধর্ষণ ও রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং থাকলে সংবাদ হবে, আর এসব না থাকলে সংবাদ নেই, এটা সত্যিকারের একজন সাংবাদিকের জন্য প্রযোজ্য নয়। প্রকৃত সাংবাদিকের জন্য ইহা লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত। রাস্তার পাশে, গলির মোড়, একটু পা ফেললে কিংবা ঘরের জানালা দিয়ে একটু উঁকি দিয়ে চতুর্দিকে দৃষ্টি সীমানায় পর্যবেক্ষণ করলে
অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, উপকরণ পাওয়া যায় সংবাদের জন্য। যেমন- শিশু শ্রম, যৌতুক প্রথা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, নিরাপদ সড়ক, জননিরাপত্তা আইন, বাজারের দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যখন-তখন বিভিন্ন সংস্থার বিনা অনুমতিতে রাস্তা খনন, শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ময়লার স্তূপ ফেলে ডাস্টবিন হিসাবে ব্যবহার করে জনগণের অসুবিধা ও নাগরিক জীবন দূর্বিষহ সৃষ্ট করা। এমন অসংখ্য বিষয় আছে যা সাংবাদিকতার সহজ বিষয় ও উপাত্ত।
সুতরাং বলা যাবেনা আজ তেমন কোনো সংবাদ নেই। একজন প্রকৃত সাংবাদিকের কাজ হল সামান্য সূত্র ধরে মেধা-মননে সুন্দর স্বচ্ছ, নির্ভেজাল যুক্তি বিশ্লেষণ দিয়ে সংবাদ উপস্থাপন ও পরিবেশন করা।
লেখকঃ কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গবেষক ও প্রধান উপদেষ্টা ধ্রুববাণী