ঢাকা ১২:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুধের টাকায় ঢাবির গাউন!

নিউজ রুম
  • আপডেটের সময় : ০৪:১৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০২২
  • / ৮২৩

দুধের টাকায় ঢাবির গাউন
ড. নজরুল ইসলাম খান


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ১৯৮৭-৮৮ সেশনে। ভর্তির পর বুঝতে পারি পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রি নিতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ক্লাস পরীক্ষা তো দূরের কথা ক্যাম্পাসে নির্ভয়ে বিচরণ করাও কঠিন। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বের হতে হতেই যৌবনের রঙিন দিনগুলো থেকে খসে পড়ল ১০টি বছর। স্বপ্নগুলো জীবনের শুরুতেই হোঁচট খেয়ে বাঁকা হলো কিছুটা। মাস্টার্স পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার কারণে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আবার উঁকি দিতে থাকলো জীবনের অলিগলিতে। ইতোমধ্যে যোগ হয়ে গেল সংসার জীবনের জটিল রসায়ন পর্ব। অনার্সের শুরুতেই বাংলাবাজারে বই লেখালেখির কাজে যুক্ত হয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায় শেষ করার মাঝেই ১০-১২টি বই বেরোয় আমার। আইডিয়াল কলেজ ও ইডেন কলেজে শিক্ষকতাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি ২০০১ সালে। যোগ দিই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। ইতোমধ্যে জানতে পারলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কনভোকেশন হচ্ছে খুব শিগগিরই। দুই হাজার টাকা জমা দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে। কনভোকেশনে যোগ দেব কি দেব না এরকম দ্বিধার মধ্যেই একদিন টাকা জমা দিতে টিএসসিতে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়ালাম। মুহূর্তেই সেলফোন বেজে উঠলো-ছেলের দুধ শেষ আজকেই দুধ কিনতে হবে। লাইন থেকে বেরিয়ে গেলাম। কোনটা বেশি জরুরি আমার কনভোকেশন নাকি ছেলের জন্য দুধ কেনা।খানিকক্ষণ চিন্তা করে ব্যাংকে টাকা জমা না দিয়েই নিউ মার্কেট থেকে ল্যাকটোজেন দুধ কিনে বাসায় ফিরে এলাম। সে দিন ছিল টাকা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট। আমি আর কনভোকেশনে যোগ দিতে পারলাম না। উত্তরা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসেই টিভির স্ক্রিনে একদিন কনভোকেশন অনুষ্ঠান দেখা হলো। মনটা ছটফট করছিলো অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য। প্রত্যাশা ছিল ছেলে যদি কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে তবে ওর সাথেই যোগ দিব ঢাবি’র কনভোকেশনে। অবশেষে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সুযোগ পেয়ে গেলাম প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম কনভোকেশনে যোগ দেওয়ার। অবশ্য এ জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৫টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে আমি আমার লক্ষ থেকে একটুও পিছপা হই নি। ছেলের জন্য বিগত ২৫ বছরে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে আমাকে। সন্তানের জীবন গড়তে বাবা মায়ের এক জীবনের সাধনার আনন্দঘন মুহূর্ত আজ। মনে হচ্ছে সে দিনের দুধের টাকায় আজকে সমাবর্তনের গাউন শরীরে জড়ালাম আমরা। এ এক অসম্ভব স্মৃতি জাগানিয়া অনুভূতি। কালো গাউন ছুঁয়ে গেল ঢাবি’র কনভোকেশনের সবুজ চত্ত্বর।

(লেখক : ড. নজরুল ইসলাম খান, অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক)



নিউজটি শেয়ার করুন








দুধের টাকায় ঢাবির গাউন!

আপডেটের সময় : ০৪:১৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০২২

দুধের টাকায় ঢাবির গাউন
ড. নজরুল ইসলাম খান


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ১৯৮৭-৮৮ সেশনে। ভর্তির পর বুঝতে পারি পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রি নিতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ক্লাস পরীক্ষা তো দূরের কথা ক্যাম্পাসে নির্ভয়ে বিচরণ করাও কঠিন। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বের হতে হতেই যৌবনের রঙিন দিনগুলো থেকে খসে পড়ল ১০টি বছর। স্বপ্নগুলো জীবনের শুরুতেই হোঁচট খেয়ে বাঁকা হলো কিছুটা। মাস্টার্স পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার কারণে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আবার উঁকি দিতে থাকলো জীবনের অলিগলিতে। ইতোমধ্যে যোগ হয়ে গেল সংসার জীবনের জটিল রসায়ন পর্ব। অনার্সের শুরুতেই বাংলাবাজারে বই লেখালেখির কাজে যুক্ত হয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায় শেষ করার মাঝেই ১০-১২টি বই বেরোয় আমার। আইডিয়াল কলেজ ও ইডেন কলেজে শিক্ষকতাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি ২০০১ সালে। যোগ দিই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। ইতোমধ্যে জানতে পারলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কনভোকেশন হচ্ছে খুব শিগগিরই। দুই হাজার টাকা জমা দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে। কনভোকেশনে যোগ দেব কি দেব না এরকম দ্বিধার মধ্যেই একদিন টাকা জমা দিতে টিএসসিতে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়ালাম। মুহূর্তেই সেলফোন বেজে উঠলো-ছেলের দুধ শেষ আজকেই দুধ কিনতে হবে। লাইন থেকে বেরিয়ে গেলাম। কোনটা বেশি জরুরি আমার কনভোকেশন নাকি ছেলের জন্য দুধ কেনা।খানিকক্ষণ চিন্তা করে ব্যাংকে টাকা জমা না দিয়েই নিউ মার্কেট থেকে ল্যাকটোজেন দুধ কিনে বাসায় ফিরে এলাম। সে দিন ছিল টাকা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট। আমি আর কনভোকেশনে যোগ দিতে পারলাম না। উত্তরা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসেই টিভির স্ক্রিনে একদিন কনভোকেশন অনুষ্ঠান দেখা হলো। মনটা ছটফট করছিলো অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য। প্রত্যাশা ছিল ছেলে যদি কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে তবে ওর সাথেই যোগ দিব ঢাবি’র কনভোকেশনে। অবশেষে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সুযোগ পেয়ে গেলাম প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম কনভোকেশনে যোগ দেওয়ার। অবশ্য এ জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৫টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে আমি আমার লক্ষ থেকে একটুও পিছপা হই নি। ছেলের জন্য বিগত ২৫ বছরে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে আমাকে। সন্তানের জীবন গড়তে বাবা মায়ের এক জীবনের সাধনার আনন্দঘন মুহূর্ত আজ। মনে হচ্ছে সে দিনের দুধের টাকায় আজকে সমাবর্তনের গাউন শরীরে জড়ালাম আমরা। এ এক অসম্ভব স্মৃতি জাগানিয়া অনুভূতি। কালো গাউন ছুঁয়ে গেল ঢাবি’র কনভোকেশনের সবুজ চত্ত্বর।

(লেখক : ড. নজরুল ইসলাম খান, অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক)