ইসলামে চরিত্রের গুরুত্ব : মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান

- আপডেটের সময় : ১২:০৮:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ জুন ২০২১
- / ৯৮২
ইসলামে চরিত্রের গুরুত্ব
মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান
মানুষের মেযাজ বুঝানোর জন্য আরবিতে ব্যবহার করা হয় আখলাক (اخلاق) শব্দটি। আখলাক (اخلاق) শব্দটি বহুবচন এর একবচন হলো খুলুকুন (خُلُقٌ)।
এই খুলুকুন শব্দটি খালকুন বা খালকান শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। এর মূল অর্থ হলো সৃষ্টি করা, তৈরি করা, অস্তিত্ব দান করা, পুরাতন করা। কিন্তু এর থেকে নেয়া আখলাক শব্দটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়। আখলাক দ্বারা জন্মগত বৈশিষ্ট্য বুঝায়, প্রাকৃতিক সুকমার বৃত্তি মেযাজ, সুন্দর মনোবাঞ্ছা, আদর্শবোধ, নৈতিকতা, স্বভাব চরিত্র, আদব বুঝায়।
বাংলায় চরিত্র স্বভাব বলতে যা বুঝায় আরবি আখলাক তেমনই কিছু বুঝায়। আখলাক বুঝানোর জন্য ইংরেজিতে যে শব্দটি অধিক ব্যবহার হয় তাহলো Character (ক্যারেক্টার)। ‘ওয়েবস্টার’ ডিকশনারির বর্ণনানুযায়ী একটি স্বভাব বা স্বভাবের উপাদানকে বুঝায়। তবে মানবীয় গুণাবলিরও অর্থ প্রদান করে, যেমন স্বভাব চরিত্র, চরিত্রের ধরণ, বোধ, ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস, সুনাম সুখ্যাতি। আখলাক শব্দটিও এই সবই বুঝায়।
আখলাকের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন অভিধানে বলা হয়েছে একটি চরিত্র মাধুর্যের জন্য যতগুণের প্রয়োজন সবগুলোই আখলাক (اخلاق) শব্দটি দ্বারা বুঝায়। সুন্দরভাবে কথা বলা, গালি না দেয়া, দান করা, দুঃখিত হওয়া, অন্যকে আনন্দ দেয়া, হিতৈষী হওয়া, সবর, সততা, স্পষ্টভাষী, শান্তভাব, লজ্জাশীলতা, বীরত্ব, বিনয়ী হওয়া, ধীরস্থিরতা, দৃঢ়তা, দৃঢ়চিত্ততা, ন্যায়বিচার, পরার্থরতা, হেকমত, সুধারণা, পোষণ, সহযোগিতা, সহনশীলতা, সময়ানুবর্তিতা, সমবেদনাবোধ, রসিকতা, মহত্ত, ভদ্রতা, ভাবগাম্ভীর্য, মহানুভবতা, ওয়াদা পূরণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অল্পেতুষ্টি, কর্মোদ্যম, ইহসান, আমানত, জবানের হেফাযত, তাওবা গোপনীয়তা রক্ষা, ক্ষমা করা ইত্যাদি।
‘অন্তর’ মানুষের ভেতরের একটি গোশত পিণ্ড। দেখা যায় না। আরবিতে বলা হয় কলবুন (قَلْبٌ)। মানুষের স্বভাবচরিত্র ওই কলব থেকে উদগত হয়। সুন্দর চরিত্র কিংবা দুষ্টযুক্ত চরিত্র সবই সেই অন্তর থেকে বের হয়। তাই চরিত্র সুন্দর হওয়ার জন্য আবশ্যক বস্তু হলো ভেতরের কলবের চরিত্র সুন্দর করা। বাহ্যিক চরিত্রের মেহনতের প্রয়োজন হয় না, কায়িক শ্রমের প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র ভেতরটা সুন্দর করলেও অটোমেটিকলি বাহ্যিক চরিত্রও সুন্দর হয়ে যাবে। তাই বলে বাহ্যিক চরিত্র একেবারে অর্থহীন নয়। এই বাহ্যিক চরিত্রটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাহ্যিক চরিত্র ছাড়া অন্তরের চরিত্রতা প্রকাশ পায় না। ব্যবহারিক চরিত্র উন্নত হলেই ভেতরের চরিত্রের উন্নতি হয় না। তাই সুন্দর চরিত্র আদব আখলাক সৃষ্টি করার জন্য অন্তরের উপর কাজ করার প্রয়োজন। একজন মানুষ তখনই মানুষ বলে গণ্য করা হবে যখন তার অন্তর মানুষ হবে। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেন, অন্তর হলো ভেতরের এমন একটি ইঞ্জিন যার থেকে মানুষের কর্মধারা প্রকাশিত হয়। এর জন্য কোনো চাপাচাপি করতে হয় না। অন্তরের যখন ইচ্ছে প্রকাশ করে। প্রকাশের এই ধারায় যদি ভালো ও উপকারী কিছু প্রকাশ হয় তাকেই বলে উন্নত চরিত্র, উত্তম আখলাক। আর প্রকাশে এই যদি পাপপঙ্কিলতা বা কলুষ রয় তাকেই বলে মন্দ বা দুশ্চরিত্র।
সুতরাং আত্মা থেকে উৎপন্ন চিন্তাকর্ম বা ভাববোধ যদি সুগন্ধি ছড়ায়, অন্ধকারকে আলোকিত করে, অসুন্দর করে সুন্দর করে, দূষিতকে দীপিত করে তবেই তা উত্তম আত্মা বা মনুষ্যচরিত্র। আর যদি আত্মা থেকে উৎপন্ন চিন্তাকর্ম বা ভাববোধ সংশ্লিষ্টব্যক্তি সমাজ দেশ ও দশকে নিকৃষ্ট করে তুলে তা-ই হলো মন্দচরিত্র, বদআখলাক। এখন যদি কেউ এমন বলে যে, তার এই কাজটি ইচ্ছেকৃত হয়। এটা মানা যাবে না। কারণ অন্তর রেকর্ড করা বস্তুর ন্যায়। ভেতরে যাই থাকবে তাই বাজবে। কে বাজালো কীভাবে বাজালো তা কিন্তু রেকর্ড করা বস্তুটি চিন্তা করবে না। এমন হবে না যে, একজন ছোট ছেলে তার পিতা-মাতার অগোচরে গান বাজাচ্ছে হঠাৎ তার পিতা উপস্থিত! এখন কী রেকর্ড করা বস্তুটি চিন্তা করবে, আমি বাজবো কী বাজবো না? না সে চিন্তা করবে না। কারণ তাকে বানানোই হয়েছে এমন ভাবে যে, বোতাম টিপলেই বাজতে থাকবে। যেই টিপ দেয় যে সময়ই টিপ দেয়। আরেকটি উদাহরণ দিই, কারো আত্মার কামনা হলো দান করা। এখন সে যখন তখন মানুষকে দান করে বেড়ায়। নিজের থাকে কী না থাকে সে দিকে তার লক্ষ্য নেই। এই আত্মার ক্রিয়াকর্মই মানুষের আখলাককে ‘আখলাকে মামদুহা (সচ্চরিত্র) ও আখলাকে মাযমুমা (দুশ্চরিত্র)’ করে তুলে।
আখলাক (اخلاق) এর প্রকারভেদ:
কিছু কিছু আখলাক বা চরিত্র আছে যা মানুষের জন্মগতভাবেই ভেতরে থাকে। আর কিছু আখলাক আছে যা মানুষ অন্যকে দেখে, পড়ে, জেনে, বুঝে, সংস্পর্শে, চাপে পড়ে অর্জন করে। প্রথম প্রকার আখলাককে যদি আমরা নাম দিই তাহলে তার নাম হবে স্বভাবজাত আখলাক আর দ্বিতীয় প্রকারের নাম হবে কাসাবি বা অর্জিত আখলাক। একজন মানুষের জীবনচরিত্রে এই দুধরনের আখলাকই জরুরি ও অত্যাবশ্যক। এই দুই আখলাকের ফলাফল অবশ্যই এক ও অভিন্ন। যদি সবগুলো আখলাকই জন্মগত হয়, তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ! আর যদি জন্মগত না থাকে, একজন সুস্থ বিবেকমান মানুষের জন্য আবশ্যক হলো দ্রুত আখলাকে মামদুহাগুলা অর্জন করে নেয়া।