ব্যবহারিক অংশ ছাড়া অর্থনীতি শিক্ষা অসম্পূর্ণ

- আপডেটের সময় : ০৭:৪৯:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ৭২৪
অর্থনীতি কেবল বইয়ের সূত্র বা সমীকরণ নয়; এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত একটি প্রয়োগমুখী শাস্ত্র। আয়-ব্যয়, সঞ্চয়-বিনিয়োগ, উৎপাদন-বাজার থেকে শুরু করে বাজেট প্রণয়ন পর্যন্ত সব কিছুই অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। তাই অর্থনীতি শিক্ষার প্রকৃত সার্থকতা অর্জনের জন্য ব্যবহারিক অংশ অপরিহার্য।
তত্ত্ব বনাম ব্যবহারিক শিক্ষা
আমাদের দেশে অর্থনীতি এখনো মূলত তত্ত্বনির্ভরভাবে পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা বই থেকে বাজার, বাজেট বা জাতীয় অর্থনীতির তথ্য শিখলেও বাস্তবে সেগুলো প্রয়োগ করার সুযোগ পায় না। এর ফলে তারা কেবল মুখস্থ বিদ্যায় সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারে না। অন্যদিকে, ব্যবহারিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার সুযোগ দেয়—যেমন মাঠে জরিপ পরিচালনা, বাজারমূল্য সংগ্রহ, বাজেট বিশ্লেষণ কিংবা গ্রাফ-চার্ট তৈরি। এসব কার্যক্রম শিক্ষার্থীর মধ্যে গবেষণামূলক মনোভাব ও সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি গড়ে তোলে।
বিশ্বে একাদশ শ্রেণিতে ব্যবহারিক অর্থনীতি শিক্ষা
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাদশ শ্রেণি থেকেই অর্থনীতিতে ব্যবহারিক অংশ অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। বিশ্বের বহু দেশ ইতোমধ্যেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
ভারত (CBSE): একাদশ শ্রেণির অর্থনীতি সিলেবাসে বাধ্যতামূলকভাবে ২০ নম্বরের প্রজেক্ট ওয়ার্ক রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের বাস্তব অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হয়।
নেপাল (NEB): গ্রেড-১১ অর্থনীতিতে Project Work অন্তর্ভুক্ত আছে, যা শিক্ষার্থীদের ফিল্ড সার্ভে ও গবেষণা কার্যক্রমে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে ।
অস্ট্রেলিয়া (VCE): ভিক্টোরিয়ার একাদশ শ্রেণির অর্থনীতিতে school-assessed coursework (SACs) চালু রয়েছে, যেখানে প্রজেক্ট ও ব্যবহারিক টাস্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয় ।
কানাডা (Ontario): অন্টারিওতে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স কোর্সে প্রজেক্টভিত্তিক কাজ বাধ্যতামূলক, যাতে শিক্ষার্থীরা বাজার কার্যক্রম বিশ্লেষণ ও বাস্তব ডেটা ব্যবহার করে শিখতে পারে।
পাকিস্তান (FBISE): ফেডারেল বোর্ডের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর অর্থনীতি সিলেবাসে Activities and Evaluation অংশ রয়েছে, যা অ্যাসাইনমেন্ট ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় ।
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো একাদশ শ্রেণি থেকেই অর্থনীতিকে ব্যবহারিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করেছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে অর্থনীতি শিক্ষা এখনো পরীক্ষাভিত্তিক ও মুখস্থ নির্ভর। শিক্ষার্থীরা তত্ত্ব শিখলেও জরিপ করা, বাজেট বিশ্লেষণ বা বাজার পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায় না। এর ফলে—
১. তারা কেবল পরীক্ষায় লিখে নম্বর পেলেও প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারে না।
২. গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণের দক্ষতা তৈরি হয় না।
৩. চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।
কেন ব্যবহারিক পরীক্ষা চালু জরুরি
একাদশ শ্রেণিতেই অন্তত ২৫ নম্বরের ব্যবহারিক পরীক্ষা চালু হলে—
*শিক্ষার্থীরা তত্ত্ব ও বাস্তবের সমন্বয় ঘটাতে পারবে।
*গবেষণামূলক মনোভাব তৈরি হবে।
*সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়বে।
*চাকরির বাজারে তারা আরও দক্ষ হয়ে উঠবে।
*জাতীয় উন্নয়নে বাস্তব অবদান রাখতে পারবে।
করণীয়
বাংলাদেশের শিক্ষা বোর্ড চাইলে আন্তর্জাতিক উদাহরণ অনুসরণ করে অর্থনীতিতে ব্যবহারিক অংশ যুক্ত করতে পারে। এজন্য—
*সিলেবাসে প্রজেক্ট ও জরিপ রিপোর্ট অন্তর্ভুক্ত করা
*ডেটা ল্যাব স্থাপন করা
*শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দেওয়া
*শিক্ষার্থীদের ফিল্ড ট্রিপে নিয়ে যাওয়া
*মূল্যায়নে ব্যবহারিক নম্বর সংযোজন করা প্রয়োজন।
উপসংহার
অর্থনীতি শিক্ষা যদি কেবল বই ও খাতায় সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ভারতের CBSE, নেপালের NEB, অস্ট্রেলিয়ার VCE, কানাডার অন্টারিও বোর্ড ও পাকিস্তানের FBISE-এর মতো বাংলাদেশেও একাদশ শ্রেণিতে অর্থনীতির ব্যবহারিক পরীক্ষা চালু করা উচিত। এটি শিক্ষার্থীদের বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান, গবেষণার দক্ষতা ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনে সহায়ক হবে।
অতএব এখনই সময় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার। অর্থনীতি শিক্ষা থেকে ব্যবহারিক অংশ বাদ দিলে তা চিরকাল অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
লেখক : প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ, মহিপুর, পটুয়াখালী।