কালো মেয়ে : তাসলিমা বেগম

- আপডেটের সময় : ০১:১০:৫৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ জুন ২০২১
- / ৮৮১
কালো মেয়ে
তাসলিমা বেগম
– আপা, ও আপা!
– কে রে? বকুল তুই! কখন এলি?
– আপা, গতকাল এসেছি।
– কার সাথে এলি?
– কেন, জানো না? শিমুল ভাইয়ার সাথে।
– কই, আমি তো কিছুই জানি না! যা-হোক, ভালোই হলো। আম্মা কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ! ভালোই আছেন।
– তা তোকে আসতে দিলো?
– জ্বি না, অনেকটা জোর করেই চলে এসেছি। এসএসসি পরীক্ষা শেষ। তোমরা দুই বোন থাকো ঢাকায়। আর আমি কি বসে থাকতে পারি, বলো?
– ঠিক আছে। ভালোই হলো। ‘ভালোই হলো’ বলছি কেন বল তো? কারণ তোর কথাই হচ্ছিল তো আলম ভাইয়ের সাথে।
– সে আবার কে?
– ঐ দেখ গিয়ে, ড্রইংরুমে বসে গান গাইছে।
– তাই! কী গান গাইছেন? আমার যে গান শুনতে ভীষণ ভালো লাগে আপা।
– তাহলে যা, গিয়ে তোর পরিচয় দিয়ে বসে পড়।
– আমি পরিচয় দিবো! তিনি কি আমাকে চিনেন?
– হ্যাঁ চিনবে, কারণ তোর কথা হয় সবসময় তার সাথে।
– ঠিক আছে, যাই তবে।
বকুল তখন ড্রইংরুমে গিয়ে বললো–‘আলম ভাই, আসসালামু আলাইকুম।’
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
হাসিমুখে জবাব দিলেন আলম ভাই। অত:পর প্রশ্ন করলেন–‘তুমি কি সেই, মানে বকুল?’
– জ্বি, আমি-ই বকুল।
নিজেদের উদ্যোগেই দু’জনের পরিচয় দেয়া-নেয়া হলো। কারণ বকুলের দুলাভাই বাসায় ছিলেন না। আর তার আপাও রান্না করছে। যা-হোক, বকুল বসে গেল গান শুনতে। কারণ আলম ভাই হারমোনিয়াম সামনে নিয়েই বসে ছিলেন।
এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন–‘গান শুনবে?’
প্রশ্ন শুনে লাজুক কণ্ঠে বকুল বললো–‘হ্যাঁ।’
প্রথমেই যে গানটি দিয়ে শুরু করলেন তাহলো :
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক
মেঘলাদিনে দেখেছিলাম মাঠে কালো মেঘের হরিণ-চোখ।।….
গান গাওয়ার সময় সে কি উচ্ছ্বাস আর আনন্দের ঝলকানি আলম সাহেবের চোখে-মুখে!
বকুলও খুব আনন্দ পাচ্ছে। সে ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট ছিল। কারণ তার মায়ের মুখে জন্মের পর থেকেই ইসলামী সব গজল-গান শুনে শুনেই বড় হয়েছে কি না তাই। তাছাড়া তার মেঝো বোন ও দুলাভাইও গানের শিল্পী। দু’জনেই গানের মাধ্যমে পরিচয় হয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে।
এবার আলম ভাই জিজ্ঞেস করলেন–‘গান কেমন হলো?’
বকুল বললো–‘খুব সুন্দর হয়েছে।’
– আরও শুনবে?
মাথা নেড়ে বকুল সম্মতিসূচক জবাব দিলো। সেইসাথে ও লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল। কারণ সে জীবনে প্রথম কোনো অপরিচিত পুরুষের সামনে বসে গান শুনছে। আলম সাহেব গান শুরু করলেন :
খোঁপার ঐ গোলাপ দিয়ে মনটা কেন এত কাছে টানলে
পারবে কি বাসতে ভালো আমাকে জানলে।।
আমাকে তেমন করেই জানলে …..
একপর্যায়ে নিজেদের মধ্যে আরও বিস্তারিত আলাপ-পরিচয় হলো। তারপর আলম ভাই বকুলের বোনকে ডেকে বললেন–‘ভাবী, আমি আসছি, আর আমার কৃষ্ণকলিকে নিয়ে যাচ্ছি!’
বকুল আশ্চর্যভাব প্রকাশ করার আগেই আপা আশ্চর্য হয়ে বললো–‘মানে! কৃষ্ণকলি আবার কে ভাই?’
– কেন, আপনার বোন।
– ও মা, তার নাম তো বকুল!
– না না, সে আমার কৃষ্ণকলি।
হাসতে হাসতে আপা বললো–‘একমুহূর্তেই আমার বোনের প্রেমে পড়ে গেছেন?’
বকুল ততক্ষণে অন্যরুমে চলে গেল এবং যেতে যেতে বললো–‘আপা, দুলাভাই তো আসলেন না! আমি বড় আপার কাছে চলে যাই।’
– তাহলে যা। কাল আবার আসবি কিন্তু।
‘আচ্ছা’ বলে বকুল বেরিয়ে গেল।
তারপর এভাবে এগুতে থাকলো গ্রামের সেই সহজ সরল মেয়েটির পথচলা। প্রায় প্রতিদিন-ই বকুল তার মেঝো বোনের বাসায় যায়। আলম ভাইও আসে, বকুলকে গান শোনায়।
গান শুনে কিন্তু আলম সাহেবের প্রতি বকুলের মনে বিন্দুমাত্র ভালোবাসার কোনো উদ্রেক হলো না। কারণ সে দেখেছে তার বোন রেখা আর রানার প্রেমের সম্পর্ক এবং তাদের বিয়ে নিয়ে নানান দুঃখজনক ঘটনা ও নানান জটিলতা। যার কারণে তার এসব ভালো লাগে না বা এই বিষয় নিয়ে তার মনে কোনো কৌতুহল নেই বললেই চলে।
তবু দিন যায়, মাস যায়। ‘এসএসসি’র রেজাল্ট বের হলো এবং বাড়ি থেকে খবর আসলো, বকুল তিনটা লেটারসহ ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছে।
রেখা, রানা ও বড় বোন এবং বড় ভাই যাদের সাথে থাকতো বকুল তারা সবাই যারপরনাই খুশি হয়েছে। উক্ত খবর যথারীতি আলম ভাইও পেল এবং মেঝো বোন ও দুলাভাইয়ের সাথে পরামর্শ করলো যে, তারা এই আনন্দের বিষয়টি কিভাবে উদযাপন করবে।
তারপর একদিন মেঝো বোন আর দুলাভাই বললো–‘চল। বকুল, তুই তো কোনদিন মার্কেটে যাসনি। আগামীকাল আমরা সবাই নিউমার্কেট আর গাউছিয়া মার্কেট ঘুরবো। সাথে আলম ভাইও যাবে।’
বকুল বললো–‘তোমরা যাও, আমি যাবো না।’
আশ্চর্য হয়ে দুলাভাই বললেন-‘কেন রে! তোর কী সমস্যা?’
বকুল বললো–‘ওই যে আপনার বন্ধু নাকি যাবে, সেই জন্য আমি যাবো না।’
– তাতে কি?
বললেন দুলাভাই।
– না। আমার লজ্জা লাগে।
– ধুর বোকা! লজ্জার কী আছে? সে তো তোর বড় ভাইয়ের মতোই।
যেই কথা সেই কাজ। পরের দিন যাওয়া হলো মার্কেটে।
জীবনে প্রথম ঢাকা শহরে আসা, তার উপরে মার্কেটে যাওয়া! যা দেখে সব-ই যেন নতুন আর অবাক হওয়ার মতো দৃশ্য বকুলের চোখে।
মার্কেট ঘুরে ঘুরে বোন-দুলাভাই লালপেড়ে সাদা শাড়ি, লাল-সাদা রেশমি চুড়ি, লাল ফিতে, জেনিসল শ্যাম্পু, টুথব্রাশ, শাড়ির সাথে ম্যাচ করে ব্লাউজ, পেটিকোট এবং সাথে কসমেটিক সব-ই কিনলো। বকুল শুধু মার্কেটের এই রঙ-বেরঙের বাহার দেখলো আর তাদের সাথে উচ্ছলতায় সময় কাটালো।
পরের দিন মেঝো আপার বাসায় গেলে আপা বললো–‘জানিস বকুল, গতকাল যা যা কেনা হয়েছে সব তোর জন্য।’
বকুল আশ্চর্য এবং লজ্জিত হয়ে বললো–‘এসব কী বলছো আপা! এগুলি দিয়ে আমি কি করবো? আমি জীবনে শাড়ি পরেছি না কি!’
বোন বললো–‘তাতে কী? আগে পরিস নাই, এখন পরবি। এখন বড় হয়েছিস না! আজ আমরা বেড়াতে যাবো মিরপুর চিড়িয়াখানায়। তুই এগুলো পরে আমাদের সাথে যাবি।’
বেশ হতচকিত হয়ে গেলেও তাদের প্ল্যানমতো শাড়ি পরে পুরো কৃষ্ণকলি সেজে বেড়াতে গেল বকুল। কিন্তু বকুল বুঝতেই পারেনি যে, এটা ছিল আলম ভাইয়ের প্ল্যান এবং তার চাওয়া অনুযায়ীই এইসব করেছে তার বোন-দুলাভাই!
চিড়িয়াখানায় গিয়ে এবার আপা-দুলাভাই একদিকে যাচ্ছে এবং বকুল আর আলম ভাইকে বলছেন–‘তোমরা অন্যদিকে যাও।’
লজ্জারাঙা চোখ-মুখ আর ভয়মিশ্রিত জড়তা ও সংকোচবোধ নিয়ে আস্তে আস্তে আলম ভাইয়ের সাথে হাঁটতে লাগলো বকুল। হায়রে! কঠিন এক মুহূর্ত মনে হচ্ছিল সেই সময় বকুলের কাছে।
আলম ভাই মহানন্দে বকুলের হাত ধরে হাঁটতে চাইছে।
কিন্তু বকুল? বারবার হাত সরিয়ে নিচ্ছে আর বিড়বিড় করে আপা-দুলাভাইকে বকছে এবং মনে মনে ভাবছে–‘কত খারাপ লোকটা, আমার হাত ধরতে চাইছে!’
ভাব-সাবে মনে হয় আলম ভাই পুরোপুরি বকুলের প্রেমে পড়েছে।
পড়ার-ই কথা। কেননা বকুল ভরা যৌবনা একটি মেয়ে। লম্বা, স্মার্ট, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুলের গোছা। মুখশ্রী বেশ আকর্ষণীয়। শুধু গায়ের রঙ কালো ছিলো। তবে যে-কেউ দেখলেই তার প্রেমে পড়ার মতো চেহারা ছিল।
আলম ভাইও দস্তুরমতো একতরফা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। সাথে সায় দিচ্ছে বকুলের বোন ও দুলাভাই।
এই যখন অবস্থা তখন বকুল তার বোনকে বললো–‘দেখ আপা, আমি ওসব প্রেম-ট্রেম করতে পারবো না। কারণ এগুলো আমার ভালো লাগে না।’
– তাহলে কী করবি? আলম ভাই তো তোকে বিয়ে করার জন্য পাগলপ্রায়।
– তাহলে আম্মাকে খবর দিয়ে তোমরা সামাজিকভাবে সামনে আগাতে চেষ্টা করো।
বকুল মুখে অন্যকথা বললেও তার মনে কিন্তু অজানা শংকা এবং আলমকে ভয়মিশ্রিত ভালো লাগা শুরু হলো।
বকুলের আম্মাকে খবর দিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে আনা হলে আলম ভাইও তার একমাত্র বোনকে আসতে বললো।
অন্যদিকে বকুলের আম্মা, বড় ভাই, আপা-দুলাভাইয়েরা ও আলম সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করে বিয়ের দেনমোহর কত ধার্য করা হবে তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলে শেষে বকুলকে ডেকে বড় দুলাভাই বললেন–‘তুই বল তো বিয়ের দেনমোহর কত ধরবো?’
বকুল তখন অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছে হবু বরের কথা। দুলাভাইয়ের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেয়ে বিরক্তির সুরে বললো–‘কী বলছো আমাকে তোমরা?’
বকুলের আম্মা এবার বললেন–‘মা, দেনমোহরের বিষয়ে তুই যা বলবি তা-ই হবে। তুই বল দিকি কত ধরা যায়?’
বকুল রাগত কণ্ঠে বললো–‘আমি যখন সব বলবো, তাহলে বড়রা রয়েছো কেন? আশ্চর্য!’
শেষে তার বড় ভাই-ই দেনমোহর নির্ধারণ করলো।
বকুলের বুঝতে বাকি রইলো না যে সম্পর্ক বহুদূর এগিয়েছে, বলা যায় নিশ্চিত হয়ে গেল।
একদিন সন্ধ্যায় আলমের বোন বকুলকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখতে আসলো। যথারীতি আপ্যায়নের আয়োজন করা হলো।
আপ্যায়নশেষে ‘কবে বিয়ে হতে পারে’ তার দিন-তারিখ নির্ধারণ প্রসঙ্গ আসতেই আলমসহ সাত ভাইয়ের আদরের বোন সুন্দরী মহিলা বললো–‘না না, এখন-ই বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার দরকার নেই।’
আলম সাহেব হতাশ হয়ে প্রশ্ন করলো–‘কি বলিস রে! আমি এতটা এগুনোর পরে তুই কী বলছিস এসব!’
তখন বকুলের নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। সাথে সাথে ভাগ্যকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে হলো।
কারণ প্রায় মাসছয়েকের মতো গান শুনে মনের মধ্যে একটা স্থান দিয়েছিল যাকে, কিছু ভালো লাগাও সৃষ্টি হয়েছিল একপর্যায়ে! অথচ আজ হঠাৎ কী হলো যে, আলমের বোন বিয়ের দিন-তারিখ পিছাতে চাইছে!
সবাই ইতোমধ্যে খুব আনন্দচিত্তে সবার মেহমানদারী নিয়েই আছে। কিন্তু বকুল কিছুটা আঁচ করতে পারলো যে, আলমের সুন্দরী বোন কৃষ্ণকলি বকুলকে পছন্দ করেনি। সেহেতু ‘জীবনের প্রথম ভালো লাগার মানুষটি বুঝি আর তার হবে না’ ভেবে হঠাৎ বজ্রপাতের মতো তার হৃদয়াকাশ যেন কালো মেঘে ঢেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন গেল।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় নিপতিত হলো এই আসরের সকলেই প্রায়। তবু বকুলের মা এসে আলমের অহংকারী বোনকে বললেন–‘মা, তোমরা কবে কখন কি করবে তা বলে গেলে ভালো হতো।’
জবাবে আলমের বোন বললো–‘আপনার মেয়ে তো কালো! তাছাড়া ছোটবেলায় মা কথা দিয়ে রেখেছেন আমার মামাতো বোনের সাথে আলমের বিয়ে দিবেন।’
হায়! বকুলের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল নিমিষেই!
জীবনের শুরুতেই এমন বদনামসূচক বিশেষণে অভিষিক্ত হওয়ার পর বকুল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, সে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে এমনভাবে, যেন এই কালো মেয়েকেই একদিন কোনো পুরুষ উপযুক্ত সম্মান ও মূল্য দিয়ে স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নেয়।
উক্ত প্রতিজ্ঞায় বকুল আলমের সাথে দেখা করা এবং কথা বলা বন্ধ করে দিলো।
একপর্যায়ে পাগলপ্রায় আলম ‘আমার কৃষ্ণকলি কোথায়’ বলতে বলতে বকুলের বড় বোনের বাসায় এসে হাজির হলো।
আলমের সাথে দেখা হলে আবার নতুন করে অপমানিত হতে পারে ভেবে বকুল বুকের মাঝে কষ্ট চেপে রেখেই কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।