মরে যাচ্ছে সোনামুখি!

- আপডেটের সময় : ০১:১৪:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ জুলাই ২০২১
- / ৯৭১
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর ও ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া এক সময়ের উজান ভাটার খরস্রোতা নদী সোনামুখি (এটি সোনাতলা নদীর শাখা নদী। তাই কবি মাইনুদ্দিন আল আতিক এর নাম দিয়েছেন সোনামুখি) আজ শুকিয়ে নালা। কোথাও আবার শুষ্কবালি, হয়তো ভবিষ্যতে এতে ধান চাষ হবে! সবার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে এক সময়ের যৌবনভরা সোনামুখি।
এক সময় এই নদীর বুকে ভেসে গিয়েছে বড় বড় লঞ্চ-ট্রলার। জেলেরা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো মাছ ধরে। এই নদী নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন উদীয়মান তরুণ কবি মাইনুদ্দিন আল আতিক। তার লেখা কবিতা ‘সোনামুখি’ সত্যিই খুব অমায়িক। যা এই সোনামুখির সাথে তীরের মানুষের ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে।
অথচ আজ নদীটি হারিয়েছে তার যৌবন, হারিয়েছে ঐতিহ্য, সেই সাথে হারিয়েছে মৎস্য সম্পদ। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়েছে নৌ-পথ। তাছাড়া বর্তমানে অতিদ্রুত ও অল্প সময়ে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে লঞ্চ ব্যবসায়ী ও ধান ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে মাছ হারিয়ে জেলেরা হারিয়েছে তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পেশা।
নদীর এপারে গাববাড়িয়া স্লুইজগেট, ওপারে থানখোলা স্লুইজগেট। দুইপাড়ের মানুষের মাঝে ছিল ভাতৃত্বের এক নিবিড়বন্ধন। যাতায়াতের সুবিধার্থে ছিল খেয়ানৌকা। ডালবুগঞ্জের মানুষ এখান থেকেই খেয়ানৌকা পার হয়ে ভাড়ায় চালিত মোটরবাইকে চড়ে মহিপুরে যেত হাট-বাজার করতে। আবার ফিরে এসে গাববাড়িয়ার দোকানগুলোয় চা-পানের আড্ডায় যাত্রাবিরতি করত।
ভাঙ্গনের কবল থেকে নদীকে বাঁচাতে সরকার বাধ নির্মাণ করায় এখন আর কাউকে খেয়ানৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এখন লোকজন বাড়ির দরজা থেকেই মোটরবাইকে চড়ে বাধের উপর দিয়ে মহিপুর বাজার কিংবা যে কোনো গন্তব্য স্থানে যেতে পারে নিমিষেই। আগের মত যাত্রা বিরতি ও চা-পানের আড্ডার সুযোগ বিলীন। ভাটা পরেছে এপার-ওপারের মানুষের মাঝের নিবিড় সম্পর্কের।
জেলেরা সারা রাত-দিন এই নদীতে মাছ শিকার করে স্লুইজ ঘাটে নৌকা নোঙর করে সকাল কিংবা শেষ বিকেলে মাছ বিক্রি করতো। এছাড়া পৌষ-মাঘ মাসে ধান ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট ট্রলার সারিবদ্ধভাবে নোঙর করে এপার-ওপারের কৃষকদের ধান ক্রয় করে ট্রলার ভর্তি করত। দু’পাড়ে ছিল সৌন্দর্য্যমণ্ডিত সবুজ দেয়াল নামে খ্যাত কেওড়াগাছসহ নানা প্রজাতির গাছ-গাছালির সমারোহ। যা আজ রাস্তার সংস্কারের কাজের অজুহাতে বিলিন করে দেয়া হয়েছে।
এক সময় সাত ভাইয়ের খেয়াঘাট থেকে এই নদী দিয়ে ‘শুকতারা’ নামক একটি লঞ্চ যেত কলাপাড়ার উদ্দেশ্যে। প্রতিটি ঘাটে ঘাটে মানুষ অপেক্ষা করতো লঞ্চ কখন আসবে, আর কখন চলে যাবে নিশ্চিন্তে উপজেলা শহর কলাপাড়ায় বা যার যার নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ভটভট শব্দে লঞ্চটি ঘোড়ার মতো ছুটে চলতো। তখন দু’পাশে বনের সবুজারণ্য আর পানিতে সূর্যের নাচ দেখতে এতটা মনোমুগ্ধকর ছিল আজও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে।
যখন ছুটিতে গ্রামে আসি মুহূর্তেই ছুটে যাই সোনামুখির তীরে। আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের অনেক স্পর্শ-আবেগ, আনন্দ-উল্লাস জড়িয়ে আছে এই নদীর সাথে। নদীর পাড়ঘেঁষা কেওড়া তলায় বসে বন্ধুদের নিয়ে দাবার আসর বসাতাম। কেটে যেত কত অলস প্রহর। ভাবতে গেলে সমস্ত অনুভূতির সীমান্তে, অনুভবে চলে আসে এক অনির্বচনীয় শিহরণ, সেসব দিন, সেসব ক্ষণ। এখনো যেন শুনতে পাই কেওড়া ডালে বসে ডেকে ওঠা কাকের কা..কা শব্দ কিংবা তপ্ত দুপুরে ঘুঘুর ডাক। পূর্ণিমা রাতের স্নিগ্ধ আলোয় আকাশে জেগে থাকা অসংখ্য তারার মত কত শত স্মৃতি। যা আষ্টেপৃষ্ঠে আজও আমাকে খাচ্ছে কুঁড়েকুঁড়ে। কি মধুময়, আনন্দ আর আবেগের ছিল সেইসব সোনালি সময়! আজ তা অতীত হয়ে সময়ের কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে। তা আর কখনো ফিরে আসবে না।
একটা সময় ছিল ভাসানী ব্যবসায়ীরা কলাপাড়ার মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাট শেষে ছোট্ট ছোট্ট নৌকা আকৃতির ট্রলার বা নৌকায় মালামাল নিয়ে একসাথে সারি বেঁধে কখনো উজানে গুন টেনে কখনো আবার জোয়ার ভাটায় দক্ষিণা বাতাসে বাদাম তুলে ডালবুগঞ্জ সাপ্তাহিক বুধবারের হাটে যেত। সে হাটে মালামাল বিক্রি করে আবার বৃহস্পতিবার মহিপুর হাটে যেতে। তাদের যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই নদীটি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে প্রকৃতির বৈরিতা ও ভাঙ্গনরোধে নদীতে বাধ দেওয়ার কারণে এমন দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।
এছাড়াও সাগর পাড়ের উপজেলা কলাপাড়ার অন্যতম বড় বড় যেসব নদীতে এক সময় ছোট-বড় লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করত, সেগুলোতে অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ, স্লুইসগেট, কালভার্ট নির্মাণ এবং চর অবৈধ দখলের কারণে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মৎস্য সম্পদের। এতে জেলেদের জীবন-জীবিকার ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে অনেকটাই। দিনদিন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে একসময়ের আরামদায়ক ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম আমাদের এই নৌ-পথ।
মানুষ মারা যায়, পশুপাখি মারা যায়, গাছগাছালি-তরুলতাও একসময় মারা যায়। কিন্তু নদীও যে মারা যায় তা চাক্ষুষ প্রমাণ আমাদের এই সোনামুখি নদীটি। মানুষ কিংবা পশুপাখি বংশধর সৃষ্টি করে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারলেও একটি নদী যা সৃষ্টি হতে লাগে দীর্ঘতম সময় তাকে এক নিমেষের মধ্যেই মেরে ফেলা যায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও আমরা একটিও নদী সৃষ্টি করতে পারবো না। তবু আমরা নির্বিচারে নদীকে মেরে ফেলছি। আমাদের উচিত এই নদীগুলোকে সংস্কার করে বাঁচিয়ে রাখা।
নদীমাতৃক আমার এই সোনার বাংলাদেশের সোনামুখি নদীর মত অসংখ্য নদীকে বাঁচাতে হলে নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরিয়ে দিতে যা যা প্রয়োজন তা করাই হবে এর প্রকৃত সমাধান।