‘জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন গণ-কল্যাণমুখী হওয়া চাই’

- আপডেটের সময় : ০৩:১০:৫৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুন ২০২১
- / ১১১৮
২০২১-২০২২ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র ও উদীমান গবেষক মোঃ মেহেদী হাসান. তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছে ভয়েস অব স্টুডেন্ট এর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্টিবিউটার জেরিন আক্তার।
[মোঃ মেহেদী হাসান বাংলাদেশ একাডেমী ফর রুলাল ডেভেলপমেন্ট (বার্ড) থেকে ২০১৮ সালে এপ্রিল মাসে গবেষণা প্রশিক্ষণ নেন। একই বছর জুলাই মাসে ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিক্স ( ডিএসসিই) থেকে উদ্যোক্তা অর্থনীতিতে জাতীয় কেইস স্ট্যাডি গবেষণা প্রতিযোগিতায় পুরুষ্কৃত হোন। ২০১৯ সালের মে মাসে ‘ইয়ুথ থটস অন ইকোনোমিক্স’ নামে উন্মক্ত জাতীয় প্রতিযোগিতায় সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) কর্তৃক পুরস্কৃত হোন। এছাড়াও, বেশ কিছু গবেষণা প্রোজেক্ট তিনি পরিচালনা করেছেন। বর্তমানে, তিনি বাংলাদেশ ইউনাইটেড স্টুডেন্টস অফ ইকনোমিক( বিউএসই) নামক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অর্থনীতি’ নিয়ে পিএইচডি গবেষণার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।]
প্রশ্নঃ- দেশের ৫০ তম বাজেট বর্তমান সরকারের টানা ২১ তম বাজেট এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রীর ৩য় তম বাজেট হিসেবে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা অংকের এই বাজেট সম্পর্কে স্যার, আপনার মূল্যায়ন কি ? এই বাজেটের আকার কি আকাশ ছোঁয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাকি সময়োপযোগী ?
জবাবঃ- বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি’র আকার ছিল ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং বাজেট ছিল জিডিপি’র ১৭.৯১ শতাংশ অর্থাৎ ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি’র আকার প্রায় ৩৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা এবং বাজেট জিডিপি’র ১৭.৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। তাহলে, আমরা বাজেট জিডিপি’র অনুপাতে দেখতে পাচ্ছি যে, বিগত বাজেটের তুলনায় এবারে বাজেট অংকের দিক দিয়ে দিয়ে কিছুটা কম। কারণ, করোনার অতিমারির মন্দা প্রভাব এবারের বাজেট প্রণয়নে প্রভাব ফেলেছে। কিছুটা বাজেট ঘাটতিও এবার দেখতে পাওয়া গেলেও এটাকে আমরা সরকারের উন্নয়নের সদিচ্ছার ধারাবাহিক বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।
প্রশ্নঃ- স্যার, আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ, বিগত অর্থ বছর আর এই অর্থ-বছরের বাজেটের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার জন্য। বাজেট ঘাটতি নিয়ে আপনি ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং এই বিষয়ে আপনার কাছে আমার হাতে প্রশ্ন ছিল। করোনা’র প্রাদুর্ভাব পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি’তে কেমন প্রভাব হতে পারে ?
জবাবঃ- বিগত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছিল ৬.১ শতাংশ এবং বর্তমান বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৬.২ শতাংশ। সুতরাং, সরকার যে বাজেট ঘাটতি বিষয়ে ভেবে দেখে নাই, এই কথা সত্য নয়। গত মে মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিসার্ভ বেড়ে ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আর গত মে মাসে’ই রেমিটেন্স ২.১৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এই সব পজিটিভ দিক বিবেচনায় রাখলে আগের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি বাজেট ঘাটতি তেমন কোন বিরুপ প্রভাব ফেলবে না। ঘাটতি বাজেটের কিছু উপকারি দিকও থাকে, যদিও যথাযথ বিনিয়োগের অভাবে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তাও থাকতে হয়।
প্রশ্নঃ- সিপিডি সহ বেশ কিছু অর্থনৈতিক গবেষণা সংগঠন এই ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার কি মনে করেন এই বাজেটে এই ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব ? আপনি বিষয়টা কিভাবে দেখছেন, স্যার ?
জবাবঃ- আগের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম যে- যথাযথ বিনিয়োগের অভাবে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা সবার’ই থাকাবে। সরকারি বিনিয়োগ সেই ভাবে বাড়ানো হয়নি, প্রাইভেট বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় এই বছরে তেমন বাড়ে নাই। সামগ্রিক বিনিয়োগে একটা স্থবিরতা কাজ করছে- এটা শুধু সিপিডি কেনো অর্থনীতির ছাত্র-ছাত্রী’ই জানেন। তারপরেও, আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ২০২১ এবং ২০২২ অর্থ বছরে যথাক্রমে ৫ শতাংশ এবং ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি’র কথা প্রোজেক্টশন করেছে। আইএমএফ এর প্রোজেক্টশনের বেশী প্রবৃদ্ধি অর্জন করার ইতিহাস বাংলাদেশের আছে। সুতরাং, আমি প্রত্যাশাবাদী এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের কাছাকাছি আমরা যাবো। এই অর্জনের পথটা আর মসৃণ হতো যদি যুব সমাজে ও এসএমই খাতে সরকারের আরেকটু জড়ালো প্রণোদনা থাকতো।
প্রশ্নঃ- স্যার, এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের করণীয় সম্পর্কে আমি আপনাকে সবার শেষে প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আগেই স্মরণ করিয়ে দিলেন সেই প্রবৃদ্ধি অর্জনের‘মসৃণ পথ’ নিয়ে। তাহলে স্যার, এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে যুব সমাজে ও এসএমই খাতের ভূমিকাটা কি ?
জবাবঃ- সুন্দর একটা প্রশ্নের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ । দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয় এসএমই খাতে এবং এই এসএমই খাতের প্রাণ ভোমরা হল যুব সমাজ। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, এমন কি বেকারত্ব দূর করার মতন ফরমাল চাকুরি পরীক্ষাগুলোও বন্ধ, অনেকের আবার চাকুরির বয়স শেষের পথে বা শেষ। যারা অর্ধ শিক্ষিত আছেন, সেই যুব সমাজের সঞ্চয়ের অর্থও এখন এই দীর্ঘ করোনা লক ডাউঁনে নিঃস্ব প্রায়। কেউবা আবার চাকরিচ্যুত হয়ে বাসায় বসে আছেন। এই বিশাল সংখ্যক যুব শক্তির দক্ষতা আছে, উদ্যোক্তা হওয়ার প্লান ও সদিচ্ছা আছে; যা নেই তা হল- তাদের ক্যাপিটাল নেই, বিনিয়োগের অর্থ নেই।
সরকার এই বাজেটে এই যুব সমাজের মাঝে মোটা অংকের এসএমই খাতের ঋণ বরাদ্দ দিতে পারতো। উদ্যোক্তা হওয়ার শর্তে স্বল্প সুদে এই যুব উদ্যোক্তা ঋণ বরাদ্দ প্যাকেজ প্রণোদনা দিতে পারতো। এসবের বিনিময়ে সরকার অনলাইনে’ই যে কোন কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন, ফি আদায়, অনলাইন ব্যবসায় ভ্যাট আদায়, পণ্য কোয়ালিটি , ভোক্তা অধিকার সহ সমস্ত কিছু মনিটারিং এবং সরকারের অর্থের এক নতুন উৎস তৈরি হতে পারতো।
এই ধরণের উদ্যোগ বেকারত্ব নিরসন, কর্মমুখী যুব সমাজ গঠন, ডিজিটালাইজেশন, স্বচ্ছ ও দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতো এবং প্রাইভেট বিনিয়োগ বাড়িয়ে কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে এগিয়ে যেত। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক ফায়দাও অনেক বেশি হত।
প্রশ্নঃ- চমৎকার, বলেছেন স্যার! আমরাও যুব শক্তির নেতৃত্বের বাংলাদেশকে বিশ্বাস করি এবং যুব সমাজের বাংলাদেশ গড়তে চাই। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মাথায় রেখে স্বাস্থ্য খাতে এই বাজেটে বরাদ্দ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি ?
জবাবঃ- স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ শতাংশ তথা ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকা স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা এবং ১০ হাজার কোটি টাকা কোভিড-১৯ এর জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলা হচ্ছে। যা হোক, স্বাস্থ্য খাতে এই বরাদ্দ আসলেই বেশ কম। কিন্তু, স্বাস্থ্য খাতে বিপদটা বরাদ্দ কম বলে নয়, মহাবিপদ হল স্বাস্থ্য খাতে লাগামহীন দুর্নীতি। স্বাস্থ্য খাতে লাগামহীন দুর্নীতি না কমিয়ে বরাদ্দ বাড়িয়ে আমি তেমন সুফল দেখি না। আর কোভিড-১৯ নিয়ে সরকারের যা যা বিগত বছরের অভিজ্ঞতা সেই আলোকে সেই একই কনফিডেন্সে একই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য খাতে আমেরিকার বরাদ্দ বাংলাদেশের টোটাল বাজেটের চেয়েও বেশি করেছিল এই বিগত বছরে, কিন্তু তাদের চেয়ে আল্লাহ আমাদের অনেকগুণ ভালো রেখেছে। সুতরাং, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত, কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতে নির্লজ্জ লাগামহীন দুর্নীতি খতম করা। মানুষের জীবন মৃত্যু নিয়ে যারা দুর্নীতি করে, তাদের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।
প্রশ্নঃ- আসলেই, মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে স্বাস্থ্য খাতের এই লাগামহীন দুর্নীতির ইতি আশু প্রয়োজন। স্যার, এই বাজেটে বড় বড় শিল্প খাত নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি ?
জবাবঃ- কোভিড-১৯ উত্তর অর্থনীতি ফিরিয়ে আনতে এই সরকারের যে স্ট্র্যাটেজি তা দেখে আমার মনে হচ্ছে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় পুর্ণাঙ্গ স্বাভাবিক উৎপাদনমুখী করাটাই সরকারের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। জিডিপি’তে শিল্পখাতের অবদানের জন্য এবং শহরকেন্দ্রিক বেকারত্বের রাজনৈতিক কলহ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য, দেশের উঁচু শ্রেণীকে স্বাভাবিক রেখেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা’ই হয়তো বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। সরকারের এই স্ট্র্যাটেজিও যথেষ্ট কার্যকরী হবে বলে আমি মনে করি। স্ট্র্যাটেজিতেই সরকার কনফিডেন্স নিয়ে এগিয়ে যাক না কেনো, সেটা শেষমেশ গণ-মানুষের উপকারে আসুক সেটাই আমরা চাই।
মোঃ মেহেদী হাসান
অর্থনীতি বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়