বেদনার নীল সাগর সিলেটের পূণ্যভূমি
✍️ মোঃ বেল্লাল হাওলাদার
প্রতি বছর বর্ষা আসলেই বন্যায় দেশের কোন না কোন অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তির হাহাকার ও প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার চিত্র চোখে পড়ে। যদিও আমাদের দেশের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করেই বেঁচে আছে। তাইতো এবার আষাঢ়ের শুরুতেই সিলেট ও সুনামগঞ্জ ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হলো। সোস্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে ফুটফুটে ছোট্ট শিশুর লাশ। বানের জলের সাথে চোখের জলে একাকার। কী মর্মান্তিক নিদারুণ করুন দৃশ্য দেখে চোখে পানি ধরে রাখা সম্ভব না। যে মা সন্তানকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে অনেক কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করে এই দুনিয়ায় আলো বাতাস পানি দেখিয়েছেন। সে-ই মা কতো অসহায় হয়ে সন্তানকে পানিতে ভাসিয়েছে হাতড়াতে হাতড়াতে বাঁচানোর জন্য কতো চেষ্টা। মায়ের চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। অজান্তেই হাত থেকে ছুটে গিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে সন্তান ডুবে মরে ভেসে গেছে!! চারিদিকে পানিতে থৈ থৈ। বৃষ্টি সাথে উজানের পানি হু হু করে বাড়ছে। কোনটা গ্রাম, কোনটা শহর কিংবা কোনটা নদী বুঝে ওঠা ছিল দুষ্কর, মনে হয় বেদনার নীল সাগর। কবরের জায়টুকু অবশিষ্ট ছিল না। সব কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা পানিতে। ধনী-গরিব সবাইকে এককাতারে নামিয়ে এনেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে।
অকল্পনীয় ক্ষতি। ঝরে গেছে অনেক নিষ্পাপ প্রাণ। ক্ষতি হয়েছে সড়ক সেতু, গবাদি পশু, পুকুরের মাছ, খেতের ফসল, গাছ-গাছালির। ঘরে পানি, রান্নার জায়গা ও শোবার জায়গা ছিল না। বিশুদ্ধ পানির অভাব, দূষিত পানিতে বসবাস। টিউবওয়েলগুলো বন্যার পানির নিচে। দোকান পাট বন্ধ। বিদ্যুৎ ছিল না, রাতের আকাশ ছিল কালো মেঘে আচ্ছন্ন। যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল বিচ্ছিন্ন। একমুঠো খাবার, ওষুধের অভাবে বাঁচতে যেখানে অনিশ্চিত অন্ধকারে জীবনযাপন ঠিক সেই মুহূর্তে ডাকাতের আতংকে দিশেহারা বন্যা দুর্গত মানুষ। নানাবিধ সমস্যায় কত কষ্ট আর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সময় পার করেছে পুরো সিলেটবাসী। যাদের এই ভোগান্তির মধ্যে সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রেখেছেন কেবল তারাই জানেন এর দুর্দশার করুন কাহিনী। ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে বুকের কষ্ট চাপা দিয়ে এক টুকরো মাটির অভাবে শিশুর লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে স্বজনরা। কী যে নিরূপায় নিদারুণ কষ্ট সহ্য করেই টিকে থাকতে হচ্ছে। তাদের সীমাহীন দুর্ভোগের চিত্র যা আমাদের কষ্ট দিয়েছে। হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে মানবতার নেত্রীর, তাইতো ছুটে এসেছেন নিজেই বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে। তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্নকে।
হয়তো এখন পানি কমতে শুরু করেছে তবে এই দগদগে ক্ষত-এর দাগ সহজেই গুছে যাবে.? রয়ে যাবে কিছুকাল বেদনা হয়ে হৃদয়ে। জনমানুষের দুর্ভোগ কেবল বন্যার পানি থাকা অবস্থায় শুধু নয়; পানি নেমে যাওয়ার পরে থাকে বিশাল চ্যালেঞ্জ তা মোকাবেলা করেই বাঁচতে হয় বন্যায় কবলিত অসহায় মানুষদের।
দেখে বেশ ভালো লেগেছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশের বিত্তবানরা। সরকারের পাশাপাশি অনেক মানবিক সংস্থার মানবিক মূল্যবোধের মানুষগুলো মহাদুর্যোগে অসহায়ত্বের পাশে সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোও। এছাড়াও সাহায্য এসেছে দেশের বাহিরে থাকা অনেক প্রবাসীর কাছ থেকে। মানবিক মূল্যবোধের মানুষগুলোর মানবিক কাজ দেখে শ্রদ্ধায় ভরে গেছে বুক আবার বিষন্নতায় হয়েছে ছারখার। যেখানে জীবন বাঁচাতে ত্রাণ বিতরণ সে-ই ত্রাণেই আবার জীবন শেষ!! বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ ফেলছে বন্যাদুর্গতদের জন্য
সে ত্রাণ সংরক্ষন করতে গিয়ে হুড়াহুড়িতে প্রাণ গেল বন্যায় সর্বহারা বিপ্লবের। আহত বেশ কয়েকজন। আহ্! কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য। উচিত ছিল সতর্কতার সাথে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা সেক্ষেত্রে ব্যর্থ বলব.? অসতর্কতার শামিল বলে বিবেচিত বলবো.?এ দায় কে নিবে.? কাকেই বা দিবো দায়। আমি অতি সাধারণ মানুষ। সেজন্যই বলি তার মৃত্যু যেভাবে লিখেছেন বিধাতা, সে ভাবেই হয়েছে। অভিযোগ করে আর কি-বা হবে। প্রভু তাকে ক্ষমা করুন।
ত্রাণ বিতরণের সময় খেয়াল রাখতে হবে গ্রামের পানিবন্দি ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ যাতে সরকারি ও মানবিক সংস্থাগুলোর সহায়তা থেকে একেবারেই বঞ্চিত যাতে না হয়। সড়কের পাশে বসবাসকারী মানুষদের একাধিকবার ত্রাণ দিয়েই যাতে ফটোসেশন না করা হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি বন্যাক্রান্ত এলাকার প্রত্যন্ত পল্লীতে দুর্গতরা যে কী পরিমাণ কষ্টে জীবন বাঁচানোর লড়াই করে তা আমরা দেখেছি ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ সিডরে। ১৯৮৮ সালের বন্যার কথাও কিছু কিছু মনে আছে তখন ছোট ছিলাম। সেই সময় সরকারের ছিলেন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। সে সময় মানুষের ঘরে খাবার ছিল সংকট অধিকাংশ লোক কৃষির ওপরে ছিল নির্ভরশীল সরকারি ত্রাণ ছিল বন্যা কবলিত মানুষের একমাত্র ভরসা। আজ দেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তাইতো মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে। মানুষই মানুষের বিপদে-আপদে বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে; গড়ে তুলছে বিভিন্ন নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা দেশের যেকোনো ভয়াবহ সংকটকালে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসে স্বেচ্ছাসেবী মানবিক হয়ে। এইতো সেদিন ও দেখেছি সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আহত-নিহত হয়েছে অনেক। সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেদিনও এগিয়ে এসেছে মানবতার সেবায়, মানুষের সেবায়, দেশের সেবায় প্রাণ দিয়েছে অনেকেই। এরা দেশের কল্যাণে কাজ করে। সরকারেও উচিত তাদের সাহসী মানবিক পদক্ষেপের জন্য সম্মানে ভূষিত করা।
মানসিকভাবে বিপর্যস্থ থাকা সিলেটবাসীকে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসা দেখে আল্লাহকে বারবার ডেকে বলি “ইয়া আল্লাহ” তুমি বিত্তশালীদের হৃদয় আরো কমল করে দাও; অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তৌফিক দান করেন। যারা পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের আরো কল্যাণের জীবন দান করেন। অতি দ্রুত এই দুর্দশা থেকে বানভাসিদের রক্ষা করে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিন। তাদের কষ্টে আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। এছাড়া আমাদের অসহায় জীবনযাপন করা মানুষের কিই’বা করার ছিল!! এভাবে যদি যার যার অবস্থান থেকে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দেশের যেকোন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসি তাহলে যেকোন দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। বাঙালি আবারো প্রমাণ করলো বন্যায় প্লাবিত হওয়া সিলেটবাসীর একা নয় পুরো গোত্র বর্ণ নির্বিশেষে পুরো দেশ তাদের পাশে আছে।
©লেখক: কবি ও সাংবাদিক