ঢাকা ০৬:৩৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মোঃ বেল্লাল হাওলাদার-এর ভ্রমণ কাহিনী “রংপুর ঘুরে এলাম”

নিউজ রুম
  • আপডেটের সময় : ০৫:২৮:৫৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
  • / ৭৪৩

রংপুর ঘুরে এলাম

প্রিয়জন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংস্থা’র রংপুর বিভাগীয় কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে শত ব্যস্ততার মাঝেও ভালো লাগাতে প্রিয়জনদের সাথে ছুটে গিয়েছিলাম ঐতিহাসিক দৃষ্টিনন্দন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার পৈতৃক বাড়ির জেলা রংপুরে।

বৃহস্পতিবার ‌রাত দশটায় আমাদের যাত্রা শুরু। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছি রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে। গাড়ির ভিতরে এসি সুশোভিত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। আমরা সফরসঙ্গী ৩০ জন কবি, সাহিত্যিক, সংগঠন ও সাংবাদিক। উত্তরবঙ্গের রাস্তার বেহাল দশা। জ্যামজট ছিল প্রচুর। যেতে ভোগান্তি হলেও গাড়ির ভিতরে ছিল মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সকলের কণ্ঠে বেজে উঠেছিলো সংগীত আর কবিতা আবৃত্তি।

সবার সাথে আমারও একটি গান পরিবেশন করতে হয়েছে। যদিও আমার কন্ঠ মোটেই ভালো নয়, তারপরেও সবার অনুরোধে গেয়েছিলাম, “সবার জীবনে প্রেম আসে তাইতো সবাই ভালোবাসে, প্রথম যারে লাগে ভালো যায় না ভোলা কভু তারে।”

চলন্ত অবস্থায় গাড়ি দুলছে, দোলনার সাথে কবি মনির ভাইয়ের গানের সাথে ‌নাচ ছিলো রোমান্টিক। এভাবে গান ও নৃত্যে উপভোগ করতে করতে আমরা রংপুরে টাউন হলে পৌঁছালাম সকাল পৌনে দশটায়। অনুষ্ঠানের স্থান পরিদর্শন শেষে খুবই ক্লান্তশ্রান্ত শরীরে হোটেলে গিয়ে উঠলাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে আবার অনুষ্ঠানে যোগদান করলাম সকাল সাড়ে দশটায়। দুই পর্বের দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রংপুরের ডিসি মহোদয় ও বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি নজরুল গবেষক রেজাউদ্দিন স্টালিন, উপস্থিত ছিলেন কবি ও অভিনেতা এবিএম সোহেল রশিদ ভাই, বিশিষ্ট ছড়াকার ও সঙ্গীত শিল্পী আতিক হেলাল ভাই, প্রিয়জন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থা’র প্রতিষ্ঠাতা মোসলেহ উদ্দিন ভাইসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশিষ্ট কবি সংগঠকরা। দুই পর্বের অনুষ্ঠান উদ্বোধনী ঘোষণা করেন প্রিয়জনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রুনা আক্তার স্বপ্না আপু। দিনটি ছিল শুক্রবার। তাই সাড়ে বারোটায় প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

আমি রংপুরে এসেছি এটা জেনে আমার অতি স্নেহের কবি বোন, প্রাণের মেলা জাতীয় কবি পরিষদের নিবেদিতপ্রাণ, রেজোয়ানা পাটোয়ারী ছুটে এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। এসে পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন স্বাচ্ছন্দ ও আনন্দের সাথে। অনুষ্ঠান বিরতির সময় আমাকে বলল, ভাইয়া চলুন আপনাকে আমাদের কলেজে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।

আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে চল……
ওদের কলেজের নাম কারমাইকেল কলেজ। অনেক বিশাল এরিয়া নিয়ে। সুন্দর জায়গা, সবুজ অরণ্য বলা যায়। এত সুন্দর পরিবেশ বেশ ভালোই লেগেছিল। যদিও আমার শরীরটা ছিল বেশ টায়ার্ড, হাঁটতে পারছিলাম না, তারপরেও ধীরে ধীরে হেঁটে কিছুটা পথ এগুলাম। একটু সামনে যেতেই চোখে পড়ল একটি বিশাল গাছ। চতুর্পার্শ্বে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে “কাইজেলিয়া” নামক সুদর্শন একটি গাছ।‌‌

রেজোয়ানা বলল, ভাইয়া পুরো এশিয়ার মধ্যে এই কাইজেলিয়া গাছ রয়েছে মাত্র পাঁচটি। এরমধ্যে আমাদের বাংলাদেশেই একটি। আর সেই গাছটিই আমাদের কারমাইকেল কলেজে। আমরা কত ভাগ্যবান তাইনা ভাইয়া.? আমি বললাম, হ্যাঁ অবশ্যই তোমরা ভাগ্যবান, এত সুদর্শন একটি গাছের নিবিড় অক্সিজেন নিতে পারছ।

রেজোয়ানা অত্যন্ত আন্তরিক ও উদার মনের একজন মানুষ এবং প্রতিভাবান কবি। গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটে। লেখাপড়ার সুবিধার্থে রংপুর শহরে বসবাস করছেন। আমাকে আদর আপ্যায়নের অনেক চেষ্টা, যদিও সময় স্বল্পতার কারণে আমি বেশি সময় দিতে পারিনি। তারপরেও তার আন্তরিকতার কমতি ছিল না, আমি মুগ্ধ এবং মুগ্ধ।

পরে আবার ফিরে এলাম অনুষ্ঠানস্থল টাউন হলে। যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু। আমাকে দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে আসন গ্রহণ করতে হয়েছে। অনুষ্ঠান অত্যন্ত চমৎকার দক্ষতার সাথে বরাবরের মতোই পরিচালনা করেছেন প্রিয়জনের প্রতিষ্ঠাতা, কবি ও নাট্যব্যক্তিত্ব মোসলেহ উদ্দিন ভাই।

নির্ঘুম রাত, লং জার্নি তারপরও আমি দেখিনি এই লোকটির কোন ক্লান্তি। হাস্যজ্জল আনন্দের সাথে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন। কোথাও এক মিনিট বসে থাকতে দেখিনি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সঞ্চালনার দায়িত্বে পালন করেছেন পুরো দ্বিতীয় পর্বজুড়ে। সন্ধ্যা ছয়টায় আলোচনা, কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানটি সমাপ্তি করা হয়।

অনুষ্ঠানের শেষপ্রান্তে ছুটে এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে প্রাণের মেলার আরেক নিবেদিতপ্রাণ কবি হাবিব রহমতউল্লাহ ভাই। শত ব্যস্ততার মাঝেও এসে আমার সাথে দেখা করলেন এবং নিয়ে গেলেন রংপুরের অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশের মিঠু হোটেলে। যথেষ্ট আদর আপ্যায়নে আমি মুগ্ধ তার আন্তরিকতায়।

এরপর চলে গেলাম হোটেলে, কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে গোসল করলাম। এরই মধ্যে খবর আসলো আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন করছেন এসময়ের অত্যন্ত দক্ষ একজন উপস্থাপক সময়ের সাহসী কবি সংগীতশিল্পী রফিকুল ইসলাম সাবুল ভাই। রংপুর শহর থেকে তার বাড়ি ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। আনন্দচিত্তে ছুটে গেলাম তার বাড়িতে। গিয়ে দেখি কত রং বাহারি সু-সাধের খাবার, গোস্ত, মাছসহ নানান ধরনের ভর্তায় সুসজ্জিত করে রেখেছেন খাবারের টেবিল। এত খাবার কী খাওয়া যায়! যাই হোক তৃপ্তি সহকারে পেটপুরে খেয়ে রওনা হলাম হোটেলর উদ্দেশ্যে। ভাবির হাতের রান্না ছিলো বেশ মজাদার। আমাদের বাস ছেড়ে চলে এলো। পথে বাসের মধ্যে প্রিয়জনের প্রধান উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ ভাই ঘোষণা করলেন আগামীকাল ঠিক আটটায় আমরা সকালে নাস্তা করে রওনা হব আমাদের পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী রংপুরের আনন্দ-বিনোদনের স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য, সবাই যথাসময়ে ঘুম থেকে উঠবেন।

যাই হোক আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। যার যার রুমে সে সে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙলো আমাদের। সবার আগে ঘুম থেকে উঠে মোসলেহ ভাই-রুনা ‌আপুরা ফ্রেশ হয়ে বসে আছেন আমাদের ‌অপেক্ষায়। আমরাও তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রওনা হলাম ভ্রমণের উদ্দেশ্য।

প্রথমে আমরা গেলাম রংপুরের ভিন্নজগতে। বাস থামল ভিন্নজগতের গেটে। তড়িৎ গতিতে নেমে পড়লো বাস থেকে মোসলেহ উদ্দিন ভাই সবার আগে। উনি নেমেই পর্যবেক্ষণ করছেন ভিন্নজগতের দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলো। আচমকা একটি প্রাইভেটকার তার পায়ের উপর চাপা দিয়ে চলে গেল। উনি বেশ গুরুতর আঘাত পেলেন। তাৎক্ষণিকভাবে ফেরদৌসী আক্তার নদী আপুর সাথে থাকা‌ হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও আমার ব্যাগে থাকা তিরয়াক নামক মেডিসিন দিলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন। পরবর্তীতে সারাদিন পায়ে গুরুতর আঘাত নিয়ে আমাদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তার নিজের শরীরের যন্ত্রণা ভুলে। শরীক হয়েছেন সকলের আনন্দে।

যাই হোক আমরা ভিন্ন জগতের গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করালাম এবং টাইম সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করে দিলেন আমাদের প্রিয় কবি জাহিদ মাহমুদ ভাই। মাত্র একঘন্টা সময় বেঁধে দিলেন তিনি। এই অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে আসতে হবে।

শুরু হলো ভিন্ন জগতের সাজানো-গোছানো সবুজ প্রকৃতির ছায়া ঘেরা পরিবেশে হেসে খেলে দেশি-বিদেশি অগণিত গাছ-গাছালির মাঝে বিভিন্ন স্টাইলের ছবি তোলা। যে‌ যেমন পারছে ছবি তুলছে। ‌সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল ‌কবি আবুল কালাম আজাদের অনুরোধ ছিল কবি আতিক হেলাল ভাইয়ের কাছে একটি সংগীত শোনার।

ভিন্নজগতের আনন্দ বিনোদনের স্থান উপভোগ করে হারিয়ে গেছে ঢাকার সেই রমনার বটমূলে। মনে পড়ে গেল সেই পরিচিত গানটি। তাইতো আতিক হেলাল ভাইয়ের কাছে অনুরোধ আবুল কালাম আজাদ ভাইয়ের। আতিক হেলাল ভাইও আনন্দিত হয়ে শুরু করলেন “রমনার রেস্তোরাঁয় নিঃসঙ্গ মেয়েটি এসে একা একা বসতো।” খুব চমৎকার সুরেলা কণ্ঠে গানটি গেয়ে পাগল করে দিলেন প্রিয় ভাই। পাখিরাও যেন তার গানে মুগ্ধ হয়ে স্তব্দ হয়ে গেছে। কিছু সময়ের জন্য আমরাও হারিয়ে গেলাম ভিন্নজগত থেকে অন্য এক ভিন্নজগতে। পরবর্তীতে গানটি ভাইরাল হয়ে গেলো সোশ্যাল মিডিয়ায়।

সময় স্বল্পতার কারণে আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা সম্ভব হয়নি। এদিকে আমাদের সময় বেঁধে দেয়া সময় আবার কখন ফুরিয়ে যায়, কখন জাহিদ মাহমুদ ভাই ডাক দিয়ে বসেন কে জানে! তাই বারবার সময়ের দিকে তাকাচ্ছি। ভাবতে না ভাবতেই মোবাইলে রিং বেজে উঠল। মোবাইলের ডিসপ্লেতে তাকিয়ে দেখি জাহিদ মাহমুদ ভাইয়ের কল।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তার কথা ভেসে উঠলো ঠিক এভাবে “হ্যালো প্রিয় কবি-সাহিত্যিক বন্ধুগণ আমাদের নির্ধারিত সময় একঘন্টা শেষ। অতিদ্রুত সবাই গাড়ির দিকে চলে আসুন। আমরা এবার চলে যাবো কান্তাজী মন্দিরে।” তো তড়িঘড়ি করে ছুটে আসলাম গাড়ির নিকটে; উঠে পড়লাম গাড়িতে।

এবার উদ্দেশ্য কান্তাজী মন্দির‌ পরিদর্শন। দিনাজপুর তেতুঁলিয়া সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেপা নদীর পাড়ে শান্ত নিভৃত কান্তনগর গ্রামে কান্তাজী মন্দিরটি স্থাপিত। বাংলার স্থাপত্য সমূহের মধ্যে বিখ্যাত এই মন্দিরটির বিশিষ্টতার অন্যতম কারণ হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে নান্দনিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা।বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নির্দশন রয়েছে এই মন্দিরে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল ‌মন্দিরটি সংস্কারের অভাবে দৃষ্টিনন্দন দেয়ালগুলোতে কালো শ্যাওলা পড়ে আছে। সংস্কার করা না হলে মন্দিরের সৌন্দর্য দিনদিন বিলীন হয়ে যাবে।

এদিকে আমাদের আতিক হেলাল ভাই ও প্রিয়জনের সভাপতি রুনা আক্তার স্বপ্না আপু, জাহিদ মাহমুদ ভাই, ফেরদৌসী আক্তার নদী আপুসহ অন্যান্যদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর দেখি তারা আমার পিছনে সেলফি তোলায় ব্যস্ত।

এবার আজব এক ঘটনার কথা বলছি। মন্দিরে প্রবেশ পথে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী মহিলা মাস্ক বিক্রি করেন। ভুলবশত আমি আমার মাস্কটি বাসে রেখে এসেছিলাম। তাই তার কাছ থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে একটি মাস্ক কিনলাম। যেহেতু করোনাকালীন সময়ে তাই অবশ্যই নিজের সেফটির প্রয়োজন ছিল।

আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল যে, আমি কান্তাজী মন্দির পরিদর্শন শেষে যখন সেই গেট থেকে বের হলাম, যে সনাতন ধর্মাবলম্বী মহিলার কাছ থেকে মাস্ক কিনলাম সেই মহিলা ভিক্ষুক সেজে বসে আছেন। আজব ব্যাপার! আমাকে বলল, বাবা আমাকে কিছু সাহায্য করুন।

আমি বললাম, আপনি তো বেশ ভালো আছেন। এখানে ব্যবসা করছেন মাস্ক সহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করছেন। ব্যবসার পাশাপাশি ভিক্ষা করা এটাও কি ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছেন.? মহিলাটি কিছুটা লজ্জা বোধ করল। বলল, বাবা বর্তমানে বেচাকেনা নাই। আগে মানুষের যে‌ সমাগম ছিল এই মন্দিরে বর্তমান দেশের যে অবস্থা খুব ভয়াবহতা! তাই মানুষ সচরাচর এখন বের হয় না তাই ব্যবসার বাজার মন্দা। তাই কি করবো পেটের দায় সবকিছুই করতে হয়। তার কথা শুনে খুব মায়া হলো তার চোখে-মুখে অভাব-অনটনের এক প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।

যাই হোক মানবতার কথা চিন্তা করে আমি তাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি আপনার কাছ থেকে পাঁচটি মাস্ক নিলাম বিনিময় পঞ্চাশ টাকা দিলাম। সে খুশি হয়ে বলল বাবা বেঁচে থাকো। এভাবে আমাদের কান্তাজী মন্দির পরিদর্শন শেষ হলো। পরবর্তীতে আমরা রওনা হলাম দিনাজপুরের রামসাগরের উদ্দেশ্য।

রামসাগরের উদ্দেশ্যে যখন আমরা রওনা হলাম পথিমধ্যে আমাদের সাথে সঙ্গ দিতে আসলেন প্রিয়জনের রংপুর বিভাগীয় সহ-সভাপতি কবি মেহেনাজ পারভীন। অত্যন্ত আন্তরিক মানুষ তিনি। তার ও প্রিয়জনের বিভাগীয় সভাপতি জুয়েল ভাইয়ের সহযোগিতায় আমরা রংপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি।

আমরা রামসাগরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমাদের গাড়ি থামলো বিশিষ্ট বেলে পাথরে বাঁধাই করা দীঘির প্রধান ঘাটে। নিমিষেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলো অপার সৌন্দর্যে। যদিও নাম রামসাগর কিন্তু সাগর দেখতে পাইনি। আমি প্রথমে ভাবছিলাম রামসাগর হয়তো আমাদের কুয়াকাটার বঙ্গোপসাগরের মত হবে পানির উত্তাল ঢেউ শোঁ শোঁ শব্দে মোহিত করবে আমাদের।

বাহ্! দেখতে পেলাম অনিন্দ্যসুন্দর গাছপালায় পাখিদের কোলাহল, সুসজ্জিত গভীর পানির এক বিশাল দীঘি সত্যি মনোরম। শুরু হলো ছবি তোলা। কেউ কেউ আবার সরাসরি লাইভ করছে রামসাগরকে ঘিরে। তার মধ্যে অন্যতম একটি লাইভ সম্প্রচার হয়েছে ফেরদৌসী আক্তার নদী আপুর। তিনি ‌কবি জাহিদ মাহমুদ, অসীম ভট্টাচার্য্য, মজিবুর রহমানসহ বেশ‌ কয়েকজনের রামসাগরের নীল স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটার দৃশ্য লাইভে সম্প্রচার করেছে। বেশ চমৎকার ছিল মুহূর্তটা।

বিশেষ করে অসীম ভট্টাচার্য্যের বিয়ে হয় না, তাই কৌতূহলবশত একজনে বলেই বসলো রামসাগরের পবিত্র পানিতে স্নান করে পবিত্র হতে পারলেই এবার অসীম ভট্টাচার্যের বিয়ে হবে। তাদের গোসল করার দৃশ্য প্রিয়জন টিভিতে দেখাতে ও ব্যস্ত‌ হয়ে পড়েছিলেন প্রিয়জনের প্রতিষ্ঠাতা, সভাপতি, প্রধান উপদেষ্টা। সেদিন কী আনন্দ বয়েছিল‌ আকাশে বাতাসে।

এদিকে কবি আতিক হেলাল, কবি শামসুল হক বাবু, কবি শিমুল ভূঁইয়া, আব্দুল আলীম, মেহনাজ পারভীন, জুয়েল আনন্দে আত্মহারা হয়ে হেলে দুলে নিলাজে, নির্জন সবুজ গাছ প্রকৃতির কলতানে হারিয়ে গেছে ছবি তোলার জগতে। সাথে আমিও ছিলাম। প্রায় দু’ঘণ্টা আমরা উপভোগ করি রামসাগরের অপার সৌন্দর্য, যা জীবনের জন্য অন্য এক অভিজ্ঞতা।

সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেল। আকাশটা ছিল মেঘলা। হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। ঠিক তখনই আমরা বেরিয়ে পড়লাম রামসাগর থেকে। গন্তব্য এবার রংপুরের উদ্দেশ্যে। রাত পৌনে নয়টায় রংপুর শহরে পৌঁছলাম। প্রিয়জন সাহিত্য পরিষদের রংপুর বিভাগীয় কমিটির সভাপতি জুয়েল ভাই একটি হোটেলে সবাইকে নিয়ে রুটি সবজি ও চা খাওয়ালেন।

তারপরে আমরা ছুটে চললাম বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন- এর বাড়ির দিকে। তখন সময় রাত দশটা। তার বাড়ির সড়কটা পাশে ছোট, বড় দুটো গাড়ি ক্রোস করা বড় কষ্টদায়ক। সড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের তার বাড়িতে ভ্রমণ করা।

সড়কের আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলো তখন ঘুমে নিরব নিস্তব্ধতা গ্রাম্য পরিবেশের মতো ‌মনে‌ হচ্ছে!
রংপুরের মেইন সড়ক থেকে তার বাড়ি আনুমানিক
তিন কিলোমিটার দূরত্ব হবে। পথে কিছুটা দুর্ভোগ হলেও আমরা তার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন রাত প্রায় এগারোটা।

তার বাড়ির মূল ফটকে গাড়ি রেখে নেমে পড়লাম। বাড়ির ভিতরে আলোকসজ্জা ছিলনা। ধূসর অন্ধকারের মধ্যে মোবাইলের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ভেতরের দিকে অগ্রসর হলাম। রাত গভীর হওয়ায় তেমন কিছু দেখার সৌভাগ্য হলো না। শুধু বেগম রোকেয়ার সুরক্ষিত সুদর্শন ছবির সাথে সবাই ছবি তুলে আনন্দিত হলাম। যাহা স্মৃতি হয়ে থাকবে। সকলের মোবাইলে গ্যালারি ভেসে বেড়াবে অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়াতে।

আমাদের ‌প্রধান আকর্ষণই ছিল বেগম রোকেয়ার স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থানের‌ স্মৃতি চিহ্নটুকু দেখার ‌অনেক আবেগ উৎসাহ ছিলো‌। শেষমেষ দেখা হলো‌ তার বাড়ির আঙ্গিনা।

বেগম রোকেয়ার বাড়ির আঙ্গিনা দেখার মধ্যদিয়ে আমাদের ভ্রমণ সমাপ্তি ঘটে। এবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। মহান আল্লাহর রহমতে সবাই সহিসালামতে যার যার বাড়িতে পৌঁছলাম পরের দিন‌ সকাল‌ ১০ টায়। মজার এই ভ্রমণের কথা হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবে। মনে থাকবে রংপুরের মানুষের আন্তরিকতা ও আতিথিয়তার কথা।

© লেখকঃ মোঃ বেল্লাল হাওলাদার, প্রতিষ্ঠাতা- প্রাণের মেলা জাতীয় কবি পরিষদ, প্রকাশক- ধ্রুববাণী।

কবি আতিক হেলাল-এর কন্ঠে গাওয়া সেই গানের ভিডিও…



নিউজটি শেয়ার করুন








মোঃ বেল্লাল হাওলাদার-এর ভ্রমণ কাহিনী “রংপুর ঘুরে এলাম”

আপডেটের সময় : ০৫:২৮:৫৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১

রংপুর ঘুরে এলাম

প্রিয়জন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংস্থা’র রংপুর বিভাগীয় কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে শত ব্যস্ততার মাঝেও ভালো লাগাতে প্রিয়জনদের সাথে ছুটে গিয়েছিলাম ঐতিহাসিক দৃষ্টিনন্দন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার পৈতৃক বাড়ির জেলা রংপুরে।

বৃহস্পতিবার ‌রাত দশটায় আমাদের যাত্রা শুরু। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছি রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে। গাড়ির ভিতরে এসি সুশোভিত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। আমরা সফরসঙ্গী ৩০ জন কবি, সাহিত্যিক, সংগঠন ও সাংবাদিক। উত্তরবঙ্গের রাস্তার বেহাল দশা। জ্যামজট ছিল প্রচুর। যেতে ভোগান্তি হলেও গাড়ির ভিতরে ছিল মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সকলের কণ্ঠে বেজে উঠেছিলো সংগীত আর কবিতা আবৃত্তি।

সবার সাথে আমারও একটি গান পরিবেশন করতে হয়েছে। যদিও আমার কন্ঠ মোটেই ভালো নয়, তারপরেও সবার অনুরোধে গেয়েছিলাম, “সবার জীবনে প্রেম আসে তাইতো সবাই ভালোবাসে, প্রথম যারে লাগে ভালো যায় না ভোলা কভু তারে।”

চলন্ত অবস্থায় গাড়ি দুলছে, দোলনার সাথে কবি মনির ভাইয়ের গানের সাথে ‌নাচ ছিলো রোমান্টিক। এভাবে গান ও নৃত্যে উপভোগ করতে করতে আমরা রংপুরে টাউন হলে পৌঁছালাম সকাল পৌনে দশটায়। অনুষ্ঠানের স্থান পরিদর্শন শেষে খুবই ক্লান্তশ্রান্ত শরীরে হোটেলে গিয়ে উঠলাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে আবার অনুষ্ঠানে যোগদান করলাম সকাল সাড়ে দশটায়। দুই পর্বের দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রংপুরের ডিসি মহোদয় ও বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি নজরুল গবেষক রেজাউদ্দিন স্টালিন, উপস্থিত ছিলেন কবি ও অভিনেতা এবিএম সোহেল রশিদ ভাই, বিশিষ্ট ছড়াকার ও সঙ্গীত শিল্পী আতিক হেলাল ভাই, প্রিয়জন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থা’র প্রতিষ্ঠাতা মোসলেহ উদ্দিন ভাইসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশিষ্ট কবি সংগঠকরা। দুই পর্বের অনুষ্ঠান উদ্বোধনী ঘোষণা করেন প্রিয়জনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রুনা আক্তার স্বপ্না আপু। দিনটি ছিল শুক্রবার। তাই সাড়ে বারোটায় প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

আমি রংপুরে এসেছি এটা জেনে আমার অতি স্নেহের কবি বোন, প্রাণের মেলা জাতীয় কবি পরিষদের নিবেদিতপ্রাণ, রেজোয়ানা পাটোয়ারী ছুটে এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। এসে পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন স্বাচ্ছন্দ ও আনন্দের সাথে। অনুষ্ঠান বিরতির সময় আমাকে বলল, ভাইয়া চলুন আপনাকে আমাদের কলেজে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।

আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে চল……
ওদের কলেজের নাম কারমাইকেল কলেজ। অনেক বিশাল এরিয়া নিয়ে। সুন্দর জায়গা, সবুজ অরণ্য বলা যায়। এত সুন্দর পরিবেশ বেশ ভালোই লেগেছিল। যদিও আমার শরীরটা ছিল বেশ টায়ার্ড, হাঁটতে পারছিলাম না, তারপরেও ধীরে ধীরে হেঁটে কিছুটা পথ এগুলাম। একটু সামনে যেতেই চোখে পড়ল একটি বিশাল গাছ। চতুর্পার্শ্বে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে “কাইজেলিয়া” নামক সুদর্শন একটি গাছ।‌‌

রেজোয়ানা বলল, ভাইয়া পুরো এশিয়ার মধ্যে এই কাইজেলিয়া গাছ রয়েছে মাত্র পাঁচটি। এরমধ্যে আমাদের বাংলাদেশেই একটি। আর সেই গাছটিই আমাদের কারমাইকেল কলেজে। আমরা কত ভাগ্যবান তাইনা ভাইয়া.? আমি বললাম, হ্যাঁ অবশ্যই তোমরা ভাগ্যবান, এত সুদর্শন একটি গাছের নিবিড় অক্সিজেন নিতে পারছ।

রেজোয়ানা অত্যন্ত আন্তরিক ও উদার মনের একজন মানুষ এবং প্রতিভাবান কবি। গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটে। লেখাপড়ার সুবিধার্থে রংপুর শহরে বসবাস করছেন। আমাকে আদর আপ্যায়নের অনেক চেষ্টা, যদিও সময় স্বল্পতার কারণে আমি বেশি সময় দিতে পারিনি। তারপরেও তার আন্তরিকতার কমতি ছিল না, আমি মুগ্ধ এবং মুগ্ধ।

পরে আবার ফিরে এলাম অনুষ্ঠানস্থল টাউন হলে। যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু। আমাকে দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে আসন গ্রহণ করতে হয়েছে। অনুষ্ঠান অত্যন্ত চমৎকার দক্ষতার সাথে বরাবরের মতোই পরিচালনা করেছেন প্রিয়জনের প্রতিষ্ঠাতা, কবি ও নাট্যব্যক্তিত্ব মোসলেহ উদ্দিন ভাই।

নির্ঘুম রাত, লং জার্নি তারপরও আমি দেখিনি এই লোকটির কোন ক্লান্তি। হাস্যজ্জল আনন্দের সাথে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন। কোথাও এক মিনিট বসে থাকতে দেখিনি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সঞ্চালনার দায়িত্বে পালন করেছেন পুরো দ্বিতীয় পর্বজুড়ে। সন্ধ্যা ছয়টায় আলোচনা, কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানটি সমাপ্তি করা হয়।

অনুষ্ঠানের শেষপ্রান্তে ছুটে এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে প্রাণের মেলার আরেক নিবেদিতপ্রাণ কবি হাবিব রহমতউল্লাহ ভাই। শত ব্যস্ততার মাঝেও এসে আমার সাথে দেখা করলেন এবং নিয়ে গেলেন রংপুরের অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশের মিঠু হোটেলে। যথেষ্ট আদর আপ্যায়নে আমি মুগ্ধ তার আন্তরিকতায়।

এরপর চলে গেলাম হোটেলে, কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে গোসল করলাম। এরই মধ্যে খবর আসলো আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন করছেন এসময়ের অত্যন্ত দক্ষ একজন উপস্থাপক সময়ের সাহসী কবি সংগীতশিল্পী রফিকুল ইসলাম সাবুল ভাই। রংপুর শহর থেকে তার বাড়ি ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। আনন্দচিত্তে ছুটে গেলাম তার বাড়িতে। গিয়ে দেখি কত রং বাহারি সু-সাধের খাবার, গোস্ত, মাছসহ নানান ধরনের ভর্তায় সুসজ্জিত করে রেখেছেন খাবারের টেবিল। এত খাবার কী খাওয়া যায়! যাই হোক তৃপ্তি সহকারে পেটপুরে খেয়ে রওনা হলাম হোটেলর উদ্দেশ্যে। ভাবির হাতের রান্না ছিলো বেশ মজাদার। আমাদের বাস ছেড়ে চলে এলো। পথে বাসের মধ্যে প্রিয়জনের প্রধান উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ ভাই ঘোষণা করলেন আগামীকাল ঠিক আটটায় আমরা সকালে নাস্তা করে রওনা হব আমাদের পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী রংপুরের আনন্দ-বিনোদনের স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য, সবাই যথাসময়ে ঘুম থেকে উঠবেন।

যাই হোক আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। যার যার রুমে সে সে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙলো আমাদের। সবার আগে ঘুম থেকে উঠে মোসলেহ ভাই-রুনা ‌আপুরা ফ্রেশ হয়ে বসে আছেন আমাদের ‌অপেক্ষায়। আমরাও তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রওনা হলাম ভ্রমণের উদ্দেশ্য।

প্রথমে আমরা গেলাম রংপুরের ভিন্নজগতে। বাস থামল ভিন্নজগতের গেটে। তড়িৎ গতিতে নেমে পড়লো বাস থেকে মোসলেহ উদ্দিন ভাই সবার আগে। উনি নেমেই পর্যবেক্ষণ করছেন ভিন্নজগতের দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলো। আচমকা একটি প্রাইভেটকার তার পায়ের উপর চাপা দিয়ে চলে গেল। উনি বেশ গুরুতর আঘাত পেলেন। তাৎক্ষণিকভাবে ফেরদৌসী আক্তার নদী আপুর সাথে থাকা‌ হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও আমার ব্যাগে থাকা তিরয়াক নামক মেডিসিন দিলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন। পরবর্তীতে সারাদিন পায়ে গুরুতর আঘাত নিয়ে আমাদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তার নিজের শরীরের যন্ত্রণা ভুলে। শরীক হয়েছেন সকলের আনন্দে।

যাই হোক আমরা ভিন্ন জগতের গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করালাম এবং টাইম সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করে দিলেন আমাদের প্রিয় কবি জাহিদ মাহমুদ ভাই। মাত্র একঘন্টা সময় বেঁধে দিলেন তিনি। এই অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে আসতে হবে।

শুরু হলো ভিন্ন জগতের সাজানো-গোছানো সবুজ প্রকৃতির ছায়া ঘেরা পরিবেশে হেসে খেলে দেশি-বিদেশি অগণিত গাছ-গাছালির মাঝে বিভিন্ন স্টাইলের ছবি তোলা। যে‌ যেমন পারছে ছবি তুলছে। ‌সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল ‌কবি আবুল কালাম আজাদের অনুরোধ ছিল কবি আতিক হেলাল ভাইয়ের কাছে একটি সংগীত শোনার।

ভিন্নজগতের আনন্দ বিনোদনের স্থান উপভোগ করে হারিয়ে গেছে ঢাকার সেই রমনার বটমূলে। মনে পড়ে গেল সেই পরিচিত গানটি। তাইতো আতিক হেলাল ভাইয়ের কাছে অনুরোধ আবুল কালাম আজাদ ভাইয়ের। আতিক হেলাল ভাইও আনন্দিত হয়ে শুরু করলেন “রমনার রেস্তোরাঁয় নিঃসঙ্গ মেয়েটি এসে একা একা বসতো।” খুব চমৎকার সুরেলা কণ্ঠে গানটি গেয়ে পাগল করে দিলেন প্রিয় ভাই। পাখিরাও যেন তার গানে মুগ্ধ হয়ে স্তব্দ হয়ে গেছে। কিছু সময়ের জন্য আমরাও হারিয়ে গেলাম ভিন্নজগত থেকে অন্য এক ভিন্নজগতে। পরবর্তীতে গানটি ভাইরাল হয়ে গেলো সোশ্যাল মিডিয়ায়।

সময় স্বল্পতার কারণে আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা সম্ভব হয়নি। এদিকে আমাদের সময় বেঁধে দেয়া সময় আবার কখন ফুরিয়ে যায়, কখন জাহিদ মাহমুদ ভাই ডাক দিয়ে বসেন কে জানে! তাই বারবার সময়ের দিকে তাকাচ্ছি। ভাবতে না ভাবতেই মোবাইলে রিং বেজে উঠল। মোবাইলের ডিসপ্লেতে তাকিয়ে দেখি জাহিদ মাহমুদ ভাইয়ের কল।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তার কথা ভেসে উঠলো ঠিক এভাবে “হ্যালো প্রিয় কবি-সাহিত্যিক বন্ধুগণ আমাদের নির্ধারিত সময় একঘন্টা শেষ। অতিদ্রুত সবাই গাড়ির দিকে চলে আসুন। আমরা এবার চলে যাবো কান্তাজী মন্দিরে।” তো তড়িঘড়ি করে ছুটে আসলাম গাড়ির নিকটে; উঠে পড়লাম গাড়িতে।

এবার উদ্দেশ্য কান্তাজী মন্দির‌ পরিদর্শন। দিনাজপুর তেতুঁলিয়া সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেপা নদীর পাড়ে শান্ত নিভৃত কান্তনগর গ্রামে কান্তাজী মন্দিরটি স্থাপিত। বাংলার স্থাপত্য সমূহের মধ্যে বিখ্যাত এই মন্দিরটির বিশিষ্টতার অন্যতম কারণ হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে নান্দনিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা।বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নির্দশন রয়েছে এই মন্দিরে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল ‌মন্দিরটি সংস্কারের অভাবে দৃষ্টিনন্দন দেয়ালগুলোতে কালো শ্যাওলা পড়ে আছে। সংস্কার করা না হলে মন্দিরের সৌন্দর্য দিনদিন বিলীন হয়ে যাবে।

এদিকে আমাদের আতিক হেলাল ভাই ও প্রিয়জনের সভাপতি রুনা আক্তার স্বপ্না আপু, জাহিদ মাহমুদ ভাই, ফেরদৌসী আক্তার নদী আপুসহ অন্যান্যদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর দেখি তারা আমার পিছনে সেলফি তোলায় ব্যস্ত।

এবার আজব এক ঘটনার কথা বলছি। মন্দিরে প্রবেশ পথে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী মহিলা মাস্ক বিক্রি করেন। ভুলবশত আমি আমার মাস্কটি বাসে রেখে এসেছিলাম। তাই তার কাছ থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে একটি মাস্ক কিনলাম। যেহেতু করোনাকালীন সময়ে তাই অবশ্যই নিজের সেফটির প্রয়োজন ছিল।

আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল যে, আমি কান্তাজী মন্দির পরিদর্শন শেষে যখন সেই গেট থেকে বের হলাম, যে সনাতন ধর্মাবলম্বী মহিলার কাছ থেকে মাস্ক কিনলাম সেই মহিলা ভিক্ষুক সেজে বসে আছেন। আজব ব্যাপার! আমাকে বলল, বাবা আমাকে কিছু সাহায্য করুন।

আমি বললাম, আপনি তো বেশ ভালো আছেন। এখানে ব্যবসা করছেন মাস্ক সহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করছেন। ব্যবসার পাশাপাশি ভিক্ষা করা এটাও কি ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছেন.? মহিলাটি কিছুটা লজ্জা বোধ করল। বলল, বাবা বর্তমানে বেচাকেনা নাই। আগে মানুষের যে‌ সমাগম ছিল এই মন্দিরে বর্তমান দেশের যে অবস্থা খুব ভয়াবহতা! তাই মানুষ সচরাচর এখন বের হয় না তাই ব্যবসার বাজার মন্দা। তাই কি করবো পেটের দায় সবকিছুই করতে হয়। তার কথা শুনে খুব মায়া হলো তার চোখে-মুখে অভাব-অনটনের এক প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।

যাই হোক মানবতার কথা চিন্তা করে আমি তাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি আপনার কাছ থেকে পাঁচটি মাস্ক নিলাম বিনিময় পঞ্চাশ টাকা দিলাম। সে খুশি হয়ে বলল বাবা বেঁচে থাকো। এভাবে আমাদের কান্তাজী মন্দির পরিদর্শন শেষ হলো। পরবর্তীতে আমরা রওনা হলাম দিনাজপুরের রামসাগরের উদ্দেশ্য।

রামসাগরের উদ্দেশ্যে যখন আমরা রওনা হলাম পথিমধ্যে আমাদের সাথে সঙ্গ দিতে আসলেন প্রিয়জনের রংপুর বিভাগীয় সহ-সভাপতি কবি মেহেনাজ পারভীন। অত্যন্ত আন্তরিক মানুষ তিনি। তার ও প্রিয়জনের বিভাগীয় সভাপতি জুয়েল ভাইয়ের সহযোগিতায় আমরা রংপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি।

আমরা রামসাগরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমাদের গাড়ি থামলো বিশিষ্ট বেলে পাথরে বাঁধাই করা দীঘির প্রধান ঘাটে। নিমিষেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলো অপার সৌন্দর্যে। যদিও নাম রামসাগর কিন্তু সাগর দেখতে পাইনি। আমি প্রথমে ভাবছিলাম রামসাগর হয়তো আমাদের কুয়াকাটার বঙ্গোপসাগরের মত হবে পানির উত্তাল ঢেউ শোঁ শোঁ শব্দে মোহিত করবে আমাদের।

বাহ্! দেখতে পেলাম অনিন্দ্যসুন্দর গাছপালায় পাখিদের কোলাহল, সুসজ্জিত গভীর পানির এক বিশাল দীঘি সত্যি মনোরম। শুরু হলো ছবি তোলা। কেউ কেউ আবার সরাসরি লাইভ করছে রামসাগরকে ঘিরে। তার মধ্যে অন্যতম একটি লাইভ সম্প্রচার হয়েছে ফেরদৌসী আক্তার নদী আপুর। তিনি ‌কবি জাহিদ মাহমুদ, অসীম ভট্টাচার্য্য, মজিবুর রহমানসহ বেশ‌ কয়েকজনের রামসাগরের নীল স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটার দৃশ্য লাইভে সম্প্রচার করেছে। বেশ চমৎকার ছিল মুহূর্তটা।

বিশেষ করে অসীম ভট্টাচার্য্যের বিয়ে হয় না, তাই কৌতূহলবশত একজনে বলেই বসলো রামসাগরের পবিত্র পানিতে স্নান করে পবিত্র হতে পারলেই এবার অসীম ভট্টাচার্যের বিয়ে হবে। তাদের গোসল করার দৃশ্য প্রিয়জন টিভিতে দেখাতে ও ব্যস্ত‌ হয়ে পড়েছিলেন প্রিয়জনের প্রতিষ্ঠাতা, সভাপতি, প্রধান উপদেষ্টা। সেদিন কী আনন্দ বয়েছিল‌ আকাশে বাতাসে।

এদিকে কবি আতিক হেলাল, কবি শামসুল হক বাবু, কবি শিমুল ভূঁইয়া, আব্দুল আলীম, মেহনাজ পারভীন, জুয়েল আনন্দে আত্মহারা হয়ে হেলে দুলে নিলাজে, নির্জন সবুজ গাছ প্রকৃতির কলতানে হারিয়ে গেছে ছবি তোলার জগতে। সাথে আমিও ছিলাম। প্রায় দু’ঘণ্টা আমরা উপভোগ করি রামসাগরের অপার সৌন্দর্য, যা জীবনের জন্য অন্য এক অভিজ্ঞতা।

সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেল। আকাশটা ছিল মেঘলা। হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। ঠিক তখনই আমরা বেরিয়ে পড়লাম রামসাগর থেকে। গন্তব্য এবার রংপুরের উদ্দেশ্যে। রাত পৌনে নয়টায় রংপুর শহরে পৌঁছলাম। প্রিয়জন সাহিত্য পরিষদের রংপুর বিভাগীয় কমিটির সভাপতি জুয়েল ভাই একটি হোটেলে সবাইকে নিয়ে রুটি সবজি ও চা খাওয়ালেন।

তারপরে আমরা ছুটে চললাম বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন- এর বাড়ির দিকে। তখন সময় রাত দশটা। তার বাড়ির সড়কটা পাশে ছোট, বড় দুটো গাড়ি ক্রোস করা বড় কষ্টদায়ক। সড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের তার বাড়িতে ভ্রমণ করা।

সড়কের আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলো তখন ঘুমে নিরব নিস্তব্ধতা গ্রাম্য পরিবেশের মতো ‌মনে‌ হচ্ছে!
রংপুরের মেইন সড়ক থেকে তার বাড়ি আনুমানিক
তিন কিলোমিটার দূরত্ব হবে। পথে কিছুটা দুর্ভোগ হলেও আমরা তার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন রাত প্রায় এগারোটা।

তার বাড়ির মূল ফটকে গাড়ি রেখে নেমে পড়লাম। বাড়ির ভিতরে আলোকসজ্জা ছিলনা। ধূসর অন্ধকারের মধ্যে মোবাইলের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ভেতরের দিকে অগ্রসর হলাম। রাত গভীর হওয়ায় তেমন কিছু দেখার সৌভাগ্য হলো না। শুধু বেগম রোকেয়ার সুরক্ষিত সুদর্শন ছবির সাথে সবাই ছবি তুলে আনন্দিত হলাম। যাহা স্মৃতি হয়ে থাকবে। সকলের মোবাইলে গ্যালারি ভেসে বেড়াবে অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়াতে।

আমাদের ‌প্রধান আকর্ষণই ছিল বেগম রোকেয়ার স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থানের‌ স্মৃতি চিহ্নটুকু দেখার ‌অনেক আবেগ উৎসাহ ছিলো‌। শেষমেষ দেখা হলো‌ তার বাড়ির আঙ্গিনা।

বেগম রোকেয়ার বাড়ির আঙ্গিনা দেখার মধ্যদিয়ে আমাদের ভ্রমণ সমাপ্তি ঘটে। এবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। মহান আল্লাহর রহমতে সবাই সহিসালামতে যার যার বাড়িতে পৌঁছলাম পরের দিন‌ সকাল‌ ১০ টায়। মজার এই ভ্রমণের কথা হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবে। মনে থাকবে রংপুরের মানুষের আন্তরিকতা ও আতিথিয়তার কথা।

© লেখকঃ মোঃ বেল্লাল হাওলাদার, প্রতিষ্ঠাতা- প্রাণের মেলা জাতীয় কবি পরিষদ, প্রকাশক- ধ্রুববাণী।

কবি আতিক হেলাল-এর কন্ঠে গাওয়া সেই গানের ভিডিও…