বসন্তে বাংলার মুখাবয়ব : মোহাম্মদ আলমগীর (জুয়েল)

- আপডেটের সময় : ১১:৫৬:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুন ২০২১
- / ৭১০
বসন্তে বাংলার মুখাবয়ব
মোহাম্মদ আলমগীর (জুয়েল)
এসেছে বসন্ত চারিদিকে সাজ সাজ রব,
প্রকৃতির অনিন্দ্য শোভা, স্নিগ্ধ সজীবতায়
বাংলার প্রান্তর ভেসে উঠে প্রাণচঞ্চল মুখাবয়ব।
জীর্ণ-শীর্ণ ঝরা পাতার বদলে আজ নব উদ্যমে,
লাল শিমুল ছেয়ে গেছে মেটো পথে কিংবা গাঁ-গ্রামে।
বাতাবু লেবুর ডালে গায় কোকিল সুমধুর গান
সারি সারি বৃক্ষের ছায়ায় বৃদ্ধা, যুব-যুবা
যুগল প্রেমিকার অন্তর উদিয়া জুড়ায় প্রাণ
সুনীল জলরাশি, ঝর্ণার ধারা,স্বচ্ছ সলিলে স্নাত অবগাহন সাম্যের পথে শান্তির বাণী-বসন্তে প্রকৃতির উদাত্ত আহবান।
প্রিয় পাঠক, বসন্তে বাঙলার মুখাবয়ব উপরোক্ত পংক্তিগুলো দিয়ে লেখা শুরু করলাম। ইংরেজিতে একটি কথা আছে— We allways like to make over statement. (বাংলায় এর অর্থ আমরা বাড়িয়ে বলতে পছন্দ করি) উপরোক্ত কথাটি ধ্রুব সত্য হলেও আমাদের প্রকৃতির রূপ ও ঋতুর বর্ণনা ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তা অপ্রযোজ্য। আর বসন্তকাল হলেতো কথা নেই। কেননা এর শুভ্র স্নিগ্ধতা ও হৃদয় নাড়ানো আমেজ মনকে এনে দেয় সজীবতা। এর মনোহর সৌন্দর্য অবলোকনে সদা আমাদের মন ব্যাকুল করে তোলে। বীরদর্পে, স্বমহিমায়,স্বরূপে, অনাবিল জৌলুস নিয়ে সহাস্যে বসন্ত আসে বাঙলায়। শুকনো ডাল-পালা, ঝরা পাতার দিন হয় শেষ।
বসন্তের আগমনে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহে ছেয়ে যায় চারিদিক। বৃক্ষরাজি, বাগ-বাগিচা, বাড়ীর আঙ্গিনা ফুল-ফলে হয় সুরভিত। গাঁয়ের মেঠো পথে, আলের ধারে নীরব-নিথর হয়ে লাল শিমুল থাকে দাঁড়িয়ে। পুষ্প কাননের সমগ্র পুষ্পের সৌরভে ধুয়ে-মুছে যায় বিগত দিনের পাপ- পঙ্কিলতা। দূর হয় প্রেমিকের বিরহ ব্যাথা,আশাহত হৃদয়ের হতাশা, দূর হয় একঘেয়েমি। ফিরে পায় মানুষ প্রাণে স্পন্দন। বন্ধুর পথ হয় সুগম। প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে বাঙলার মুখাবয়ব। বসন্তে মানুষে, মানুষে হিংসা বিদ্বেষ ভেদাভেদ ভুলে সাম্যের পথে পা বাড়িয়ে একই সূতোয় হয় আবদ্ধ। চারিদিক বয়ে যায় আনন্দ হিল্লোল। কিশোর-কিশোরী হন্যে হয়ে শিমুল ফুল কুড়িয়ে বেড়ায়।
কর্মমুখর ক্লান্ত পথিক চলার পথে বৃক্ষের ছায়ায় একটু গা এলিয়ে দিয়ে মুক্ত বায়ুতে বুক ভরে-প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। খানিক পর আনমনা, অবচেতন মনে রাজ্যের ভাবনা এসে দোলা দেয়। সংসার ধর্ম-কর্ম, ছাওয়াল———-ইত্যাকার ভাবতে, ভাবতে কর্মমুখর পথিক আলস্য জড়তা দূর করে প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পুণরায় গন্তব্য স্হানের উদ্দেশ্য পথ চলতে শুরু করে। ” মাত্রাধিক নিদ্রা-বিশ্রাম পরকালের ভীতি ” গাঁয়ের সহজ-সরল মুখ মানুষগুলো প্রকৃতির মতো উদার, বসন্তের বিশালতার সাথে মিশে একাকার হয়ে খাঁটি দিলে মনে-প্রাণে তা বিশ্বাস করে।
সারাদিন অনেক খাটা-খাটুনির পর উদরের গহীনে স্বামীর উপহার স্বরূপ রত্মটি বোঝা বহনের ক্ষমতা যখন হারিয়েফে লে অনবরত বমি হয় এবং ক্লান্তি আসে। তখন পুকুর পাড়ের কচি আম্র স্বাদ গ্রহণ করে কর্মচঞ্চল অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ একটু স্বস্তি পায়। তারপর প্রকৃতি -বসন্তকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বাতাবু লেবুর ডালে কোকিলের
কুহু কুহু মধুর ডাক শুনে সদা ভরা যৌবন প্রাপ্ত যুবতী বুঝে নেয় এখন বসন্তকাল। সেই সাথে অনুভব হয় তার শরীরেও ভরা যৌবনের বসন্ত এসেছে। তারপর খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেহে হাতের পরশ বুলিয়ে নিজেকে দেখে আর চোখ বুজে ভাবে কবে আসবে জীবনসঙ্গী, প্রত্যাশিত নাগর? এই বসম্তে
নাকি অন্য বসন্তে———————
বয়সের ভারে জরাগ্রস্ত, রুগ্ন বৃদ্ধা মলিন বদনে পরকালের প্রস্তুতি নিতে ব্যতিব্যস্ত। বসন্তের আগমনে হঠাৎ স্মৃতিতে যৌবনের বসন্তের কথা তার স্মরণ হয়। কিছুটা সুখকর অনুভূতি বোধ করে পরক্ষণে হতাশায় বিহ্বল হয়ে ভাবে আমার যৌবনের বসন্ত ফুরিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্ত প্রকৃতির বসন্ত ঠিক আগের মতো সতেজ, প্রাণবন্ত আছে। বৃদ্ধের হৃদয় অনাবিল ধারায় বয় বেদনার প্রসবন। তারপর নিরাশ হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয় আর দুই চোখের কোণে জমে অশ্রু।