ঢাকা ০৬:৪৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফুলি : জেসমিন ইসলাম

নিউজ রুম
  • আপডেটের সময় : ০২:৩৮:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুন ২০২১
  • / ৭৩৯

গল্প

ফুলি
জেসমিন ইসলাম

বর্ষায় একদিন অল্প বৃষ্টি পড়ছিল।সময়টা ছিল দুপুরের মাঝামাঝি ।আমি জানালা দিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছিলাম ।কারন আমার বৃষ্টি দেখতে খুব ভাল লাগে ।দেখতে পেলাম সামনের পুকুরে কতগুলো দশ-এগারো বছরের ছেলে- মেয়ে মনের আনন্দে পানিতে লাফালাফি করছে ।কেউ বা সাঁতার কাটছে আবার কেউ বা পানি নিয়ে মারামারি করছে ।এসব দেখতে দেখতেই হঠাৎ চোখ পড়ল পাশে বসে থাকা তাদেরই বয়সের এক মেয়েকে,সে তাদের মত লাফালাফি করছে না।সাঁতার ও কাটছে না।
শুধুই বিষণ্ণ মনে নিষ্পাপ দৃষ্টিতে তাঁদেরকে দেখছে।হয়ত তার মনের মধ্যেও প্রবল ইচ্ছে করছে তাদের মত খেলা করার ।
জানি না সে কি ভাবছে ?
কিন্তু আমার তাঁর নিষ্পাপ চেহারা দেখে এটাই মনে হলো ।আর কীভাবেই বা মেয়েটা তাদের মত বৃষ্টির মজা নিবে।কারণ তার তো একটি পা নেই ।মেয়েটিকে দেখে আমার সেই ফুলি নামের মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল
ফুলির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল আমার নিজের বাসায় ।দিনটি ছিল ছুটির দিন ।একটু আলসেমি করেই সেদিন ঘুম থেকে দেরি করে উঠলাম ।দেখলাম আমাদের রান্না ঘরের সামনে লাল ফ্রক পরা নিষ্পাপ চেহারার দশ-এগারো বছরের একটি মেয়ে ।হাতে স্ট্রেচার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।মেয়েটির এই করুন অবস্থা দেখে কষ্ট হলো,যেহেতু তাঁর মা আমাদের বাসায় কাজ করত সেই সুবাদে প্রায়ই তার সাথে দেখা হত।মাঝে মধ্যে কথাও হত,কিন্তু প্রায় দেখতাম আমার স্কুলে যাওয়ার সময়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ।মাঝে মধ্যেই এসে জিজ্ঞেস করত কোথায় যাচ্ছি?একদিন কৌতূহলীবশত জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম যে,সে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকে কেন?জবাবে সে তাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলল,আপনে যখন স্কুলে যান তখন আমার খুব স্কুলে যাইতে মনে কয় ।বললাম আমি স্কুলে যায় পড়াতে।তার প্রতি আমার খুব মায়া হলো,তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,তোর নাম কি? সে তার নাম বলল,ফুলি ।ফুলি বুঝি কারো নাম হয়?আমি ফুল বেচিতো তাই হগলে আমারে ফুলি ডাহে।পড়ার প্রতি তাঁর এই প্রবাল আগ্রহ দেখে তাকে বললাম তোর মায়ের সাথে কথা বলব ।তোকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য ।সে আচ্ছা বলেই চলে গেল।কেই বা জানত এই
সাক্ষাতটাই ছিল আমার ফুলির সাথে শেষ দেখা।এরপর অনেক দিন কেটে গেল ।পরীক্ষা কাছে চলে আসায় ফুলির কথা আপাতত আমি ভুলে গেলাম ।একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে দেখলাম রাস্তায় অনেক মানুষের ভীড় ।রিকশা আর যাবে না বলে বাকি পথটা আমি হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম ।ভীড় ঠেলে কিছুদূর সামনে যাওয়ার পর জানতে পারলাম যে এখানে একটি মেয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকের ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট হয়েছে ।কিছুদূর যাওয়ার পরেই দেখতে পাই সে আর কেউ নয়; আমার অতি পরিচিত সেই ফুলি নামের মেয়েটি।তাঁর লাল রক্তে পিচঢালা রাস্তা লাল রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল,তার লাল ফ্রক আরও রঙিন হয়ে উঠেছিল ।আদুরে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছিল কয়েকটি মালা, বেলি ও চাঁপা ফুলের ।হায় পৃথিবী ! এই তোমার নিষ্ঠুর খেলা?এই তোমার নিয়তি ?এই ছোট্ট মেয়েটিকেও তুমি রেহাই দিলে না।পরীক্ষার ব্যস্থাতার চাপে তার কথা ভুলে গিয়ে ছিলাম ।আর আসল নামটিও জানা হলো না তার!কখন যে মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ;ফুলি যে আমার হৃদয়ে এতটাই দাগ কেটে আছে তা ভাবতেই পারিনি এতদিন ।



নিউজটি শেয়ার করুন








ফুলি : জেসমিন ইসলাম

আপডেটের সময় : ০২:৩৮:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুন ২০২১

ফুলি
জেসমিন ইসলাম

বর্ষায় একদিন অল্প বৃষ্টি পড়ছিল।সময়টা ছিল দুপুরের মাঝামাঝি ।আমি জানালা দিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছিলাম ।কারন আমার বৃষ্টি দেখতে খুব ভাল লাগে ।দেখতে পেলাম সামনের পুকুরে কতগুলো দশ-এগারো বছরের ছেলে- মেয়ে মনের আনন্দে পানিতে লাফালাফি করছে ।কেউ বা সাঁতার কাটছে আবার কেউ বা পানি নিয়ে মারামারি করছে ।এসব দেখতে দেখতেই হঠাৎ চোখ পড়ল পাশে বসে থাকা তাদেরই বয়সের এক মেয়েকে,সে তাদের মত লাফালাফি করছে না।সাঁতার ও কাটছে না।
শুধুই বিষণ্ণ মনে নিষ্পাপ দৃষ্টিতে তাঁদেরকে দেখছে।হয়ত তার মনের মধ্যেও প্রবল ইচ্ছে করছে তাদের মত খেলা করার ।
জানি না সে কি ভাবছে ?
কিন্তু আমার তাঁর নিষ্পাপ চেহারা দেখে এটাই মনে হলো ।আর কীভাবেই বা মেয়েটা তাদের মত বৃষ্টির মজা নিবে।কারণ তার তো একটি পা নেই ।মেয়েটিকে দেখে আমার সেই ফুলি নামের মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল
ফুলির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল আমার নিজের বাসায় ।দিনটি ছিল ছুটির দিন ।একটু আলসেমি করেই সেদিন ঘুম থেকে দেরি করে উঠলাম ।দেখলাম আমাদের রান্না ঘরের সামনে লাল ফ্রক পরা নিষ্পাপ চেহারার দশ-এগারো বছরের একটি মেয়ে ।হাতে স্ট্রেচার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।মেয়েটির এই করুন অবস্থা দেখে কষ্ট হলো,যেহেতু তাঁর মা আমাদের বাসায় কাজ করত সেই সুবাদে প্রায়ই তার সাথে দেখা হত।মাঝে মধ্যে কথাও হত,কিন্তু প্রায় দেখতাম আমার স্কুলে যাওয়ার সময়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ।মাঝে মধ্যেই এসে জিজ্ঞেস করত কোথায় যাচ্ছি?একদিন কৌতূহলীবশত জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম যে,সে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকে কেন?জবাবে সে তাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলল,আপনে যখন স্কুলে যান তখন আমার খুব স্কুলে যাইতে মনে কয় ।বললাম আমি স্কুলে যায় পড়াতে।তার প্রতি আমার খুব মায়া হলো,তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,তোর নাম কি? সে তার নাম বলল,ফুলি ।ফুলি বুঝি কারো নাম হয়?আমি ফুল বেচিতো তাই হগলে আমারে ফুলি ডাহে।পড়ার প্রতি তাঁর এই প্রবাল আগ্রহ দেখে তাকে বললাম তোর মায়ের সাথে কথা বলব ।তোকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য ।সে আচ্ছা বলেই চলে গেল।কেই বা জানত এই
সাক্ষাতটাই ছিল আমার ফুলির সাথে শেষ দেখা।এরপর অনেক দিন কেটে গেল ।পরীক্ষা কাছে চলে আসায় ফুলির কথা আপাতত আমি ভুলে গেলাম ।একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে দেখলাম রাস্তায় অনেক মানুষের ভীড় ।রিকশা আর যাবে না বলে বাকি পথটা আমি হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম ।ভীড় ঠেলে কিছুদূর সামনে যাওয়ার পর জানতে পারলাম যে এখানে একটি মেয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকের ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট হয়েছে ।কিছুদূর যাওয়ার পরেই দেখতে পাই সে আর কেউ নয়; আমার অতি পরিচিত সেই ফুলি নামের মেয়েটি।তাঁর লাল রক্তে পিচঢালা রাস্তা লাল রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল,তার লাল ফ্রক আরও রঙিন হয়ে উঠেছিল ।আদুরে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছিল কয়েকটি মালা, বেলি ও চাঁপা ফুলের ।হায় পৃথিবী ! এই তোমার নিষ্ঠুর খেলা?এই তোমার নিয়তি ?এই ছোট্ট মেয়েটিকেও তুমি রেহাই দিলে না।পরীক্ষার ব্যস্থাতার চাপে তার কথা ভুলে গিয়ে ছিলাম ।আর আসল নামটিও জানা হলো না তার!কখন যে মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ;ফুলি যে আমার হৃদয়ে এতটাই দাগ কেটে আছে তা ভাবতেই পারিনি এতদিন ।